সাপ্তাহিক গল্প নেই-তে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – ৪

গল্প নেই – ৪
সকালবেলা অতীন হঠাৎ হাজির।বাড়িতে কেউ এলে অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়।হেসে বললাম,‘এস।’
ওকে ভয় পাওয়ার মতো কোনো ব্যাপার আমার ক্ষেত্রে তখনও ঘটেনি।তবে এলাকার অনেকে অতীনকে ভয় পায়।আবার তারা প্রয়োজনে যায়ও ওর কাছে।একটা রাজনৈতিক দলের নেতার কাছাকাছি ওকে দেখা যায়।ওর ছোটোকাকা আমার বন্ধু।হয়ত সেই সুবাদেই ওর কাছ থেকে কোনো কটু ব্যবহার আমাকে কখনো সহ্য করতে হয়নি।
অতীনের সঙ্গে তখনও কথা শুরু হয়নি হঠাৎই যতীন এল।এই সকালে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হব এমন আশঙ্কা করিনি।অতীনের বিপক্ষ দলে আছে যতীন।মাঝে মাঝেই এরা দু’জন লড়াইয়ে নেমে পড়ে।
এলাকায় প্রমোটারকে চমকে দখল করে,প্রতি স্কোয়ার ফুটে তোলাবাজি।বাইকে আওয়াজ করে ভেলকিবাজি।কখনও রক্তদান শিবিরে কান খুলে যাবার অবস্থা করে সারাদিন মাইকে ধুমধাড়াক্কা গান।আবার কখনো পস্পরের রক্ত নিয়ে হোলি খেলা।সঙ্গে আছে নানা উৎসব।শনি পুজো থেকে ইলিশ অবধি কিছুই বাদ যায় না।তখন আমাদের শান্তিতে বেঁচে থাকাটা বিপন্ন হয়।
আমাকে চমকে দিয়ে যতীন অতীনকে বলল,‘কিরে তুই কতক্ষণ?’সেন্টার টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখনও চা পাসনি তো।যাক ভালোই হয়েছে।দু’জনে একসঙ্গেই পাব।’
অতীন আসার আগেই আমাকে চা দেওয়া হয়েছিল।শেষ চুমুক গলায় ঢেলে যতীনের কথা শুনে চা গলায় আটকে গেল। কাশতে শুরু করলাম।
অতীন ও যতীনের যৌথ উদ্যোগের সেবায় নিজেকে সামলে নিলাম খানিকটা।
ওদের জন্য শুধু চা এল না।সঙ্গে খাবারও।হয়ত এলাকায় শান্তির বাতাবরণ তৈরি হওয়ায় আমার বাড়ির লোকও খুশি।ওরা দু’জনে বেশ খানিকটা সময় আমার কাছে কাটিয়ে একসঙ্গে হাসিমুখে চলে গেল।ঠিক যেমনটি ওদের ছোটোবেলায় দেখতাম।
অতীন ও যতীন যে দু’টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত তারা মানে তাদের দলের উপর তলার নেতারা সম্প্রতি পরস্পরকে ভালোবাসতে শুরু করেছেন। টিভির খবরে, কাগজে দেখছি একজন অন্যজনের প্রশংসা শুরু করলে আর থামতে পারছে না।এই হাওয়ায় অতীন আর যতীন কাছাকাছি এসে গেছে।
আমার আরও কয়েকজন যুবকের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল।যারা আর নেই।কোনো রোগ তাদের মৃত্যুকে ডেকে আনেনি।তারা অতীন যতীনের সঙ্গে থেকে পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে বোমা,পাইপগানের আদরে খতম হয়েছে।অতীন,যতীন আর তাদের দলের ছেলেদের কাছে ঝোলান থাকে চাকরি বা যে কোনো প্রতিশ্রুতির খুড়োর কল।সবাই মনে করে নিজেদের নেতা নেত্রীদের হয়ে গুলি বোমা নিয়ে লড়াই করে পরস্পরকে মারলে মিলতে পারে কিছু।তারা যখন লড়াই করে তখন তাদের বাঁচাবার জন্য কেউ থাকে না।অথচ নেতা নেত্রীদের নিরাপত্তার জন্য কত আয়োজন কত খরচ। আসলে তাঁরা তো সব নন্দলাল।তাঁরা না বাঁচলে দেশের কি হইবে? যত উলুখাগড়া তাদের প্রাণ গেলে বেকার সমস্যার তো অনেকটাই সমাধান।
তাই সারাক্ষণ হুংকার,এখান থেকে শুরু হবে পেটাই,গুলি মারো শালেকো,গুলি কর বুকে এমনই আরও অনেক অমৃত বাণী।
এইসব আগুনে কি পাওয়ার আশায় পতঙ্গের মতো আছড়ে পড়ে মায়ের অজস্র সন্তানেরা?
অতীন যতীন ও তাদের বন্ধুরা শুধু হারিয়ে যায়।
যারা নেই তাদের ফিরিয়ে আনা যাবে না।শত চেষ্টা ও চোখের জলেও না।নেতাদের মধ্যে সমঝোতা হলে ও অন্যান্য দলের নেতা নেত্রীরা যদি বুঝতে পারেন এভাবে হিংসার আগুন জ্বালান ঠিক নয় তবে যারা এখনও আছে তারা থাকবে বহুদিন।
হাফ চাকরি,পোয়া চাকরির ছ্যাবলামির হাত থেকে মুক্তি পাবে। পেয়ে যাবে একটা সুন্দর জীবন।কোনো পাওনা আদায়ের জন্য শীতের রাতে পথে উপোস করে প্রতিবাদ জানাতে হবে না।শিশু পুত্র কন্যা,বয়স্ক বাবা মা ও স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে থাকতে পারবে।
এমন ভাবনায় একটা সুখের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল মনের ভিতরে।
কিছুদিন বাদে অতীনের সঙ্গে রাস্তায় দেখা।যতীনের কথা জিজ্ঞাসা করতে কেমন অসন্তুষ্ট হল।আমি কথা না বাড়িয়ে অফিসে যাবার বাস ধরবার জন্য এগোলাম।
সকালে খবরের কাগজটা দেখা হয়নি।অফিসে গিয়ে কয়েকজনের কথায় টের পেলাম অতীন,যতীনের দলের নেতারা পরস্পরকে আর ভালো চোখে দেখছে না।নির্বাচনে জোট করে লড়াই করতে গিয়ে আসন ভাগাভাগি করবার সময় চট করে কোনো সুস্থ সিদ্ধান্তে নিজেদের মাথাকে কাজে লাগাতে পারছে না।অন্যদিকেও সারাক্ষণ তুই কেডা,আর মুই কেডা।
অতীনের অসন্তুষ্ট হবার কারণ বুঝলাম।
জানিনা আবার যদি ওদের নেতারা পরস্পরকে ভালো বলে তাহলে কি অতীন যতীনের দিকে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে লজ্জা পাবে?