ক্যাফে গল্পে কুহেলী দাশগুপ্ত

বিবর্ণ বৈধব্য
রাঙামাসি ঘাটকাজের কাপড় পৌঁছতে এসে বলেছিল,
–আমার দিদিকে তোমরা লাল ছাড়া সব পরতে দিও। মা ওকে এই বেশে দেখলে সইতে পারবেনা।
–স্বাদ আহ্লাদ কিছু কি আর বাকি আছে গো?সবই তো খুইয়ে এসেছে।ক’দিন আগে সিতু টা জন্ডিস থেকে সেরে উঠলো ।এরপরই বিদেশ বিভুঁইয়ে বেড়াতে যাওয়া !ছোট চাইলে ঠেকাতেই পারতো।
জ্যাঠাইমার কড়া ভাষণ।
রাঙা মাসি চুপ করে শুনে যায়। কিছু তো বলার নয়!বাড়ি ভর্তি লোকজন।
তিতলি রাঙামাসিকে ডেকে মায়ের কাছে নিয়ে যায়। মা কখনো থম মেরে, কখনো ডুকরে কেঁদে উঠছে।–
–অনু, তোর জামাইবাবু আমাদের একদম ভাসিয়ে চলে গেল।
চিরকালের মুখরা তিতলি বলে ওঠে,
–একদম বলবেনা এসব। আমি ও বাবাকে হারিয়েছি। তুমি এতো ভেঙে পড়লে সব পেয়ে বসবে । এখনই তো কতরকম কথা শুরু হয়ে গেছে ।
বছর তেরোর তিতলির মুখে এসব কথা ভালো লাগেনা মা আর রাঙামাসির।
— বড়দের মাঝে কথা বলতে নেই তিতলি।
—দ্যাখ না অনু, মেয়েটাকে বুঝিয়ে পারি না। এতো মুখ খোলে!
তিতলি ও দমবার পাত্রী নয়।
–তোমরা আমায় থামিয়ে রাখতে পারো।কিন্তু, সবাই যখন বেপরোয়া ভাষণ দিয়ে কান ঝালাপালা করবে,সব কিছু হজম করতে হবে।
গজগজ করতে করতে বার হয়ে যায় তিতলি।
দেড় মাস জন্ডিসে ভোগার পর তিতলির বাবা সিতাংশু একঘেঁয়েমি কাটাতে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করে ফেলে। থাইল্যান্ড যাওয়ার টিকিট একদম কনফার্ম করে বাড়িতে জানায়। সিতাংশু চিরকাল নিজের সিদ্ধান্তের বাইরে কখনো কারো মতকে প্রাধান্য দেয়নি।তিতলির মা রঞ্জনা তো একেবারেই মাটির ধাঁচের।
মেয়েকে সব সময় বলে চলে,
–মেয়েদের তরলমতি হতে হয়। যে পাত্রে স্থান পায়, তার আকার নিতে হয়।
এই তরলমতি স্বভাব সহধর্মিনী পেয়ে বেপরোয়া সিতাংশু আরো ও।
বন্ধুদের নিয়ে রঙিন তরলের নেশা অনেককালের। কখনো বেসামাল নয়। তবুও শরীর খারাপের আশঙ্কায় রঞ্জনা আপত্তি জানালেও সে বাধা গুরুত্ব পায়নি সিতাংশুর কাছে।
বড় জা মীরা এই নিয়ে কথা শোনাতে ছাড়তো না।
শ্বশুর শাশুড়ির কান ভারি করা।
–ছোট চাইলে কি সিতুকে আটকাতে পারে না!
এসব তিতলির অনেক কালের দেখা ও জানা। ওর শুধু মন চাইতো, সব কিছু ভেঙে চূড়ে নতুন করে সাজিয়ে নিতে। সব কিছু তো মনের মতো চাইলেই পাওয়ার নয়! বাবা কে থাইল্যান্ড থেকে কফিন বন্দি হয়ে ফিরতে হোল। ব্রেইন হেমারেজ।
–রঞ্জনা, তুমি সাদা রঙের ছোট পাড় শাড়ি পরতে পারো। লাল, নীল, সবুজ, গোলাপী, হলুদ,খয়েরী, কালো এসব রঙ না পরলেই ভালো। সেজ পিসি বলে।
–মায়ের আলমারিতে এতগুলো শাড়ি, এগুলোর কি হবে? লাল না হয় পরলো না। অন্য রঙে কি সমস্যা?
অন্যের ওপর মতামত চাপিয়ে দেয়া খুব সহজ, যতক্ষণ নিজেকে না এসবের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়!
তিতলির কথায় সেজ পিসি রেগে যায়।
–তোর মা কে যা খুশি পরতে দে। আমার আর কি?লোকে নিন্দে করবে।
কতকাল, কত বছর পেরিয়ে গেল। চালশে ধরা চোখেও অস্বচ্ছ কিছু নয়। তিতলি ভাবে, কখনো কি মায়ের ব্যথা গুলো কেউ মন দিয়ে ছুঁয়েছে? শুধুই নিয়মের বেড়াজালে জড়িয়ে রাখতে চাওয়া! বাবা ও তো স্বাধীনতা দেয়নি! চলে যাবার কালে যেন সব রঙ ধুয়ে দিয়ে যাওয়া! তিতলি অনেক কিছুই মানতে পারে না। এত নিয়মের বেড়াজালে আটকে থেকে বিমর্ষ জীবন বয়ে চলা! বৈধব্য কারো কাঙ্খিত রূপ নয়, এ রূপ সমাজের তৈরি। মন চাইলে জীবন রঙিন হতে পারে। মা ভালো গাইতো। বাবা কি কখনো শুনতে চেয়েছে সেই গান?কখনো উৎসাহ দিয়ে পাশে থাকার কথা ভেবেছিল?
তিতলি বলেছিল মা কে,
–তোমার বাকি জীবন সাদা চূণের প্রলেপ দিয়ে কাটবে,এ আমি হতে দেবো না।
দুঃখ গুলো চকের গুঁড়ো যেন!ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চায় সে।নিয়মের ঘেরাটোপ পার করে,অনেকটা পথ হেঁটে চলেছে সে। অনেক প্রশ্নের ভিড়ে উঁকি দেয় , এলোমেলো জিজ্ঞাসা।
বিবর্ণতা কেবল কি বৈধব্যের বেশ! তা তো নয়।শাঁখা সিঁদুর সাজে ঘর ভরা ছেলে,বউ, নাতি, নাতনীদের মাঝে ও তো মনমরা মানুষগুলো একাকীত্বে ভোগে। ফেলে আসা সুখ স্মৃতি কেবল ফটো অ্যালবামের পাতায়। লাল ,নীল, হলুদ, সবুজের মাঝে থেকেও বিবর্ণ নিঃসঙ্গতা! অনেকের মাঝেও অব্যক্ত হৃদয়ের আকূতি খুঁজে চলে মনকে উজার করে দেয়ার কোনও সঙ্গী।
চিরকালের সরব তিতলির ভাবনাগুলো মনের আনাচে কানাচে ছুটোছুটি করে। তার কাছে জীবন শুধু দু’চোখ ভরে দেখার,অনুভবের। জীবনে জড়িয়ে থাকা মানুষেরা হারিয়ে গেলে , শূন্যতার মাঝে ডুবে থাকা নয়। বিবর্ণতা আসলে কিছু জনের মনের রঙ।সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছয় না,চাঁদের মায়াবী আলো স্নিগ্ধতা ছড়ায় না। ধূসর গোধূলি তে জমা হয় যত ধূলোর আস্তরণ।