কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব – ৪

বাংলার ভূঁইয়াতন্ত্র

বারো ভূঁইয়ার কথা বলতে গেলে সবার প্রথমে সারা বাংলার পরিস্থিতি এবং তার সঙ্গে জড়িত দিল্লির রাজনৈতিক অবস্থাটাও পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। বাংলার বারো ভূঁইয়া ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর সেক্ষেত্রে সবার প্রথমে আসে তোডরমল কর্তৃক বাংলায় রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন। রাজা তোডরমল ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান এবং সরল প্রকৃতির লোক। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে বাদশা তাকেই বাংলার নবাব নিযুক্ত করে পাঠালেন। আর তারপর বাংলার ভূমি সংস্কারে তার ভূমিকা আজও আলোচিত হয়। সারাদেশে মুঘল সালতানাতকে বিভিন্ন সময় ভাগ করা থেকে রাজস্ব আদায়ের সমস্ত চিন্তাভাবনা আসলে তারই। আসলে আজকের দিনের এই যে মৌজা পরগনা ইত্যাদি ভাগ সেসব প্রথম রাজা তোডরমলেরই মাথায় এসেছিল। তাই মুঘল শাসনব্যবস্থাকে তিনি এক অন্য মাত্রায় নিয়ে চলে যান। আর তাই রাজস্ব সংগ্রহে তার সময়কালের মত উৎকর্ষতা আর কখনও দেখা যায়নি। বাংলায় এসে তিনি এই বঙ্গদেশ থেকে বিভিন্নভাবে আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনাগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। এই সময় সমস্ত বঙ্গদেশ মোট ১৯ টি সরকারের বিভক্ত হয়। তারমধ্যে জেন্নেতাবাদ, তাণ্ডা, ফতেহাবাদ, পূর্ণিয়া, বাকলা, ঘোড়াঘাট, সিলেট, চট্টগ্রাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই প্রত্যেকটি সরকারের অধীনে ছিল মহাল বা মহকুমা। আর সেগুলি থেকে আলাদা আলাদা করে রাজস্ব সংগ্রহ করা হতো বিভিন্ন শাসকদের সাহায্যে। টোডরমল বাংলায় আসবার পর বাদশার রাজস্ব পরিমাণ অনেকটা বৃদ্ধি হল। আর তাতে খুশি হয়েই সম্রাট আকবর তাঁকে রাজা উপাধি দিয়ে প্রধান দেওয়ান পদে নিযুক্ত করে দিলেন। এবং তারপরে আজিজ খাঁকে বাংলার নবাব পদে প্রেরণ করলেন।
সেই সময় বাংলার এক উল্লেখযোগ্য শাসকের নাম ইশা খাঁ। তাঁর পিতার নাম ছিল কালিদাস গজদানি। বিষয়টা বেশ অবাক করার হলেও এরা ছিলেন রাজপুত বৈশ্য জাতীয়। অযোধ্যা থেকে ব্যবসার জন্য বাংলায় এসে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সোনারগাঁওয়ের কাছে নিজেদের বিষয় সম্পত্তি নিয়ে বাস করতেন। কালিদাসের ছিল দুই পুত্র – ইশা খাঁ এবং ইসমাইল খাঁ। এক যুদ্ধে কালিদাসের পরাজয়ের পর এই দুই পুত্র বণিকদের হাতে বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু তারপরে ইশার এক কাকা কুতুব খাঁ তাদের আবার এই দেশে নিয়ে আসেন। ইশা খাঁ ছিলেন বুদ্ধিমান। আর তাঁর বিভিন্ন গুণাবলী দিয়ে তিনি সর্বসাধারণের কাছে বেশ সুখ্যাতি লাভ করেন। কিন্তু তাঁর চরিত্রেও কিছু খারাপ দিকও ছিল। যেমন কপটতা, স্বার্থপরতা ইত্যাদি। কিন্তু এসব বাদ দিলে তাঁর বীরত্ব এবং স্বাধীনতার চেতনা ইতিহাসে বহু চর্চিত। মুঘল সম্রাটের সাথে বহুবার মিত্রতা স্থাপন করেও তাঁর আনুগত্য তিনি অস্বীকার করেন। আর সেই জন্য বাদশার সঙ্গে তার বিবাদের অন্ত ছিল না।
আমরা জানি আকবরের সময়কালে বঙ্গদেশ প্রথম মুঘলদের হস্তগত হয়। যদিও এই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে বাদশাকে অনেক কাটখড় পোড়াতে হয়েছিল। তাই নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিলেও তা সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন হয়নি সেই সময়েও। কারণ তখনও পাঠান সামন্তদের ক্ষমতা একেবারে শূন্য হয়ে যায়নি। আর তারা বারবারই চেষ্টা করেছেন মুঘল হাত থেকে বাংলাকে নিজেদের মতো করে স্বাধীন করতে। এমনকি বাংলার ভূস্বামীরাও তাদেরকে সাহায্য করতে কসুর করেননি। তাই সে দিক থেকে মুঘলদের সঙ্গে বাংলায় হানাহানি একটা লেগেই থাকত। ইশা খাঁ তখন খিজিরপুরে পাঠান দলের নেতা। নীতি নির্ধারকও বটে। প্রায় সমগ্র রাজত্বকালই তিনি যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে মেতে থাকতেন। খিজিরপুরে তাঁর দুর্গ বারবার অন্য শাসকদের দ্বারা হস্তগত হয়েছিল। এমনকি তাঁর অস্ত্রাগার এবং ভান্ডারখানাও অন্যের অধিকারে চলে যায়। ইশাকে একবার পালাতেও হয়। কিন্তু তারপরেও তিনি প্রচুর সৈন্য এবং রসদ সংগ্রহ করে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং নিজের শৌর্য প্রদর্শন করেন।
রাজা মানসিংহের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলার ইশা খাঁকে পরাস্ত করা। কারন সেই সময়ে যত বিদ্রোহী দল ছিল তারা সকলেই প্রায় ইশা খাঁয়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে এক বিশাল বিরোধী দলে পরিণত হয়েছিল। আর ঠিক এই সময়ই রাজা মানসিংহ আর সময় নষ্ট না করে খিজিরপুরে ঈশা খাঁর রাজধানী অবরোধ করেন। তখনই ভয়ানক যুদ্ধ বাঁধে ইশার সাথে মানসিংহের। মুঘল সৈন্যদল সমেত মানসিংহের সম্মুখীন হতে ইশা একবারও চিন্তা করেননি। তরবারি চালানো দুজনেই সিদ্ধহস্ত। এমনকি তাদের দুজনের মধ্যে যুদ্ধে শোনা যায় একবার মানসিংহের তরবারি ভেঙ্গেও গেল। কিন্তু ইসা তাকে কখনোই হত্যা করেননি। আর যুদ্ধে শত্রুর কাছ থেকে এমন অযাচিত প্রাণ দান পেয়ে মানসিংহ ইশা খাঁয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়েন। দিল্লির বাদশাহের ক্ষমতা সম্বন্ধে ইশা খাঁ যথেষ্টই অবগত ছিলেন। আর তাই তিনি সরাসরি কখনোই বাদশাহের বিরোধিতা করেননি। বরং মানসিংহকে বেকায়দায় ফেলবার পরেও তিনি বাদশাহের আনুগত্য স্বীকার করার কথাই বলেন। কিন্তু নিজের খিজিরপুর তথা সোনারগাঁও তিনি কখনোই হাতছাড়া করে মুঘলদের হাতে তুলে দিতে চাননি। বাংলার বারো ভূঁইয়ার মধ্যে ইশা খাঁকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে অনুমান করা হয়। কারণ তাঁর ক্ষমতা এবং বীরত্ব ছিল এক কথায় অপ্রতিরোধ্য। সাধারণ এক পরিবার থেকে উঠে এলেও তিনি ছিলেন শৌর্য এবং বীর্যের প্রতীক। মুঘল সম্রাট আকবরের মতো প্রতিপত্তিশালী বাদশাও এক কথায় কখনও তাঁর সাম্রাজ্য দখল করে নিতে পারেননি। এর থেকেই বোঝা যায় প্রকৃতভাবে ঠিক কতটা শক্তিশালী ছিলেন সোনারগাঁওয়ের ইশা খাঁ।
শোনা যায় ঈশা খাঁ তাঁর ইন্দ্রিয় পরায়ণতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আর এক বারো ভুঁইয়ার মধ্যে অন্যতম কেদার রায়ের কন্যা স্বর্ণময়ীকে অপহরণ করেন। আর সেই সময় কেদার রায় ইশা খাঁয়ের সোনারগাঁও আক্রমণ করেন। পরবর্তীকালে ১৫৯৯ সালে কোন এক অজ্ঞাত রোগে তিনি মারা যান। অধুনা বাংলাদেশের গাজীপুর জেলায় তাঁকে সমাধিস্ত করা হয়। বর্তমানে তার সমাধিস্থলকে সংস্কার করে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। বাংলার ইতিহাসে তাঁর ভূমিকা এক কথায় অবিস্মরণীয়। বাংলার বীর ভূঁইয়াদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। তাই অনেকেই তাকে বারো ভূঁইয়ার প্রধান বলে উল্লেখ করেছেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *