সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ২৯)

কলকাতার ছড়া
অতিরিক্ত গোমাংস ভক্ষণের ফলে মৃত্যু। তাও আবার গোঁড়া হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল এক পরিবারের সদস্যের। মৃত্যুর এহেন রিপোর্ট যাঁর কথা স্মরণ করাচ্ছে, তিনি একসময়ের ভারত বিখ্যাত ল্যান্ড সার্ভেয়র রাধানাথ শিকদার। আবার গোঁড়া হিন্দু পরিবারের ছেলে হয়ে বন্ধুদের পার্টিতে গোমাংস ভক্ষণ। পরিণামে হিন্দু সমাজে একঘরে করে দেওয়া। কিন্তু উদ্যম না হারিয়ে ধর্মত্যাগ করে সোজা খ্রীষ্টমন্ত্রে দীক্ষাগ্রহণ ও কলকাতায় খ্রীষ্টধর্মের প্রচার। যাঁর কথা বলছি তিনি রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁরা সকলেই হিন্দু কলেজের ডিরোজিয়ান। পলাশী যুদ্ধের পরে কলকাতায় গোড়াপত্তন হয় এক নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপট। যেখানে ইংরেজ তাঁবেদারির পুরস্কার হিসাবে খুব তাড়াতাড়ি মিলে যেত রাজাবাহাদুর বা রায়বাহাদুর খেতাব। উদযাপনও ছিল আশ্চর্যের। মা দূর্গাকে উপলক্ষ্য করে কলকাতার বহু বড়লোক বাড়ি মোচ্ছব দেখেছে সেকালে। দেখেছে বাইজী নাচ, ধুলোর মতো টাকাখরচ। এই তোষামোদীর প্রতিযোগিতা অসুস্থতায় পরিণত হলে ও আপামর কলকাতাবাসীর মেরুদণ্ড ভেঙে দিলে ভীষণ ভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ে একদল একদম নব্য শিক্ষিত যুবকের। কিন্তু ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত নব্য যুবকের দল মেতে উঠলো নতুনের আনন্দে। ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গলে একঝাঁক তরতাজা তরুণ। গোঁড়া ব্রাহ্মণ বাড়ির যুবক থেকে ধনী ব্যবসায়ী ও কায়েত বংশের ছেলে। কৃষ্ণমোহন থেকে দক্ষিণারঞ্জন, রাধানাথ থেকে প্যারীচাঁদ, সকলের চোখেই তখন রঙিন স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্ন থেকেই বেড়া কেটে মুক্তির আস্বাদ পাওয়া। বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েও সীমাহীন মদ্যপান করতে তারা দুবার ভাবেননি কোনোদিন। আর স্বভাবতই বিষয়টা ভালো চোখে নেয়নি কলকাতা শহর। চারদিকে তীব্র সমালোচনার ঝড়। যে ঝড়ে নিজের চাকরি পর্যন্ত বাঁচাতে পারেন নি স্বয়ং ডিরোজিও সাহেব। হিন্দু কলেজের দরজা থেকে চাকরি ত্যাগ করে ফিরে আসতে হয় তাঁকে। কিন্তু এরপরও থেমে থাকেননি তিনি। ছাত্রদের নিয়ে ইয়ং বেঙ্গল গঠন আর বাংলার সামাজিক আকাশে তুমুল ঝড়ের উদ্রেক, এই ছিল এই সাহেবের কর্মসূচি। হয়ত একটা ঘুণ ধরা সমাজে হঠাৎ একঝাঁক প্রতিবাদী মুখের জন্ম হয় তাঁরই নেতৃত্বে, কিন্তু বাইরে থেকে এই মদ্যপ যুবকদের সমালোচনা করতে ছাড়েননি কেউ। বিপরীতেও তৈরি হয় সংরক্ষণশীলদের সমিতি। মাতালবিরোধী এই সভার নেতৃত্ব দিলেন অধ্যাপক প্যারীচরণ সরকার। সাহেবদের দেখাদেখি মদের আসর খুলে বসা বাঙালীদের ধরে ধরে মদ বিরোধী মুচলেকায় সই করানো তাঁর প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য। ফল পাওয়াও যাচ্ছিল ভালো, কিন্তু মুচলেকা ভঙ্গকারীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। মদ ছেড়ে কেউ কেউ আবার গাঁজায় ডুবলেন। সে যাই হোক, সদ্য সাবালক বাঙালীর কাছে সে এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণ। ইয়ং বেঙ্গলের দেখাদেখি ভুঁইফোড় বাঙালীর দলও মদকে আপন করে তুললে গান ধরলো কলকাতার কবির দল। ধীরাজ কবিয়াল গাইলেন –
মধুপান কোরো না
ইয়ং বেঙ্গল বাঁচবে না…
তখন কলকাতায় কবিগানের রমরমা খুব। নামি-দামি কবিয়ালরা দল গড়ে জমিদার বাড়িতে কবিগানের তর্জা বসাতো। উপভোগ্য সেইসব লড়াইতে লোকও কম হত না নেহাত। এই কবিয়ালদের মধ্যেই কেউ কেউ বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ধীরাজ কবিয়াল তেমনই এক বিখ্যাত কবিয়াল। চলমান ঘটনা নিয়ে মুখে মুখে গান বাঁধা তার নেশা। ঠিক তেমনই এক কথ্যছড়া এটি৷ ইয়ং বেঙ্গলকে দেখে মদ্যপানে অভ্যস্ত বাঙালীকে তিনি ছড়া গানের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন নি। যেকোনো চোখে পড়বার মত ঘটনারই যুক্তি পাল্টা যুক্তি থাকবেই৷ সে যুগেও ছিল৷ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও বাঙালী সমাজের হঠাৎ বদলানো হাল হকিকত নিয়ে নিয়মিত ব্যঙ্গাত্মক ছড়া লিখতেন সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায়। রমরমিয়ে চলতো সেই কাগজ। কিন্তু সমাজ চলেছে তার নিজস্ব গতিতেই। রাজা বাহাদুর রাধাকান্ত দেব, বাবু মতিলাল শীলদের মত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরাও যেমন হাজার চেষ্টা করেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে তাঁর সংকল্প থেকে আটকাতে পারেন নি, ঠিক তেমনই হাজার বিরোধীতা সত্ত্বেও প্রতিহত করা যায়নি ডিরোজিও ও তার ইয়ং বেঙ্গল নামক ঝড়ের দামাল গতিপথকে। তবু কথায় কথায় ছড়া বেঁধেছে বাঙালী। আর নিমেষে সেইসব ছড়া ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন দিকের মানুষের মুখে মুখে।