• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (ইতিহাস কথা পর্ব – ১৮)

শ্রীরামপুরের কথা

১৮১৮ সালের এপ্রিল ও মে মাসে পরপর ছাপানো শুরু হয় দিগদর্শন ও সমাচার দর্পণ। মার্শম্যান সাহেবের সম্পাদনায় ২৩ শে মে প্রকাশিত হল সমাচার দর্পণের প্রথম সংখ্যা। ঠিক হয় সাপ্তাহিক এই পত্রিকা প্রতি শনিবার করে প্রকাশ করা হবে। শ্রীরামপুর ও কলকাতায় একযোগে এই পত্রিকা এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে প্রতি শনিবারের বদলে সপ্তাহে দুদিন করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দিনগুলি ছিল বুধবার ও শনিবার। দেশীয় ও বিলেতের সমস্ত খবর নিরপেক্ষ ভাবে পরিবেশন করে সমাচার দর্পণ হয়ে ওঠে সেযুগে বাঙালীর একমাত্র মুখপত্র। শুধু সমাচার দর্পণই নয়। এরপর ১৮৪০ সালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ও মার্শম্যান সাহেবের সম্পাদনায় শ্রীরামপুর প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয় গভর্নমেন্ট গেজেট। জোশুয়া মার্শম্যান ছিলেন কর্মব্রতী। একসাথে তিনটি নিয়মিত কাগজের দায়িত্ব নিয়ে মিশন প্রেস থেকে প্রকাশ করবার মতো দায়িত্বপূর্ণ কাজ তিনি বলেই হয়ত এভাবে সম্ভব হত। কিন্তু এতগুলো পত্রিকার চাপে শেষমেশ সমাচার দর্পণ প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর উপায়ও ছিল না তাঁর হাতে। অবশেষে বন্ধও হয়ে গেল সমাচার দর্পণ। ১৮৪১ সালের ২৫শে ডিসেম্বর রীতিমতো নোটিশ দিয়ে বন্ধ করা হয় সমাচার দর্পণের প্রকাশ। ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়াতে ৩০শে ডিসেম্বর প্রকাশিতও হল সেই খবর।
“The editor of the Samachar Darpan finds himself under the necessity of closing that journal with the termination of the present year.”
ও হ্যাঁ, কথায় কথায় বলে নিই ইংরাজি সংবাদপত্র ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়ার কথা। ১৮৩৫ সালে ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া সাপ্তাহিক ভিত্তিতে মানুষের সামনে আসে। রাজনৈতিক পক্ষপাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এই সংবাদপত্রতে প্রকাশিত সতীদাহ বিরোধী প্রবন্ধ পড়ে বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক পর্যন্ত নড়েচড়ে বসেন। এমনকি পাল্টা চিঠি দিয়ে এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার কথাও জানান। দেশের উন্নতির লক্ষ্যে বিভিন্ন খবর প্রকাশে ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া ছিল অগ্রগণ্য। কিন্তু সঙ্কট যেন পিছু ছাড়েনি কখনো। ১৮৭৪ সালে এহেন পাইওনিয়ার সংবাদপত্রের কপালে নেমে এলো অশনিসংকেত। তখন স্টেটসম্যান সংবাদপত্র চালাচ্ছেন রবার্ট নাইট।
মার্শম্যান ও মিশনারীদের কাগজ ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া বিক্রি হয়ে গেল তাঁর কাছেই। তখন মিশনারীর সমস্ত বিষয়ে দেখাশোনা করছেন জোশুয়া মার্শম্যান পুত্র আর এক অগ্রণী কর্মবীর জন ক্লার্ক মার্শম্যান সাহেব। নগদ ৩০০০০ টাকায় হাতবদল ঘটে গেল ইংরাজি সংবাদপত্রটির। এরপর দি স্টেটসম্যানের সাথেই যৌথ ভাবে ছেপে বেরোতে থাকে ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া। সেই অর্থে দেখতে গেলে আজও স্টেটসম্যান দৈনিকের মধ্যেই যেন আমাদের অজান্তেই লুকিয়ে রয়েছে মার্শম্যান সাহেবের শখের কাগজ ‘ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া’।
সেই সময় শ্রীরামপুর প্রেস থেকে জন ক্লার্ক মার্শম্যান সাহেবের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হচ্ছে দিগদর্শন। কী নিবন্ধ ঠাঁই পেত না সেখানে। উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে ভারতে আসবার পথ আবিষ্কার, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভার বিবরণ থেকে শুরু করে হিন্দুস্থানের ভৌগলিক সীমা অথবা দেশের প্রধান প্রধান বাণিজ্য বিবরণ – সবই ছাপা হত সুচারু ভাবে। অতি যত্ন করে ছাপা দিগদর্শন ছিল একটি ২৪ পৃষ্ঠার কাগজ। নীল মলাট আর এখনকার বইয়ের মতো প্রথমেই সূচিপত্র। এমন সাজানো নিবন্ধপত্র আজকের ককম্পিউটার যুগে প্রচুর দেখা যায়। প্রায় দুশো বছর আগে এমন করে সাজিয়ে সংবাদপত্র করা বিরলই বলা চলে।
আগেই বলেছি শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাগজ বেঙ্গল গভর্নমেন্ট গেজেটের কথা। ১৮৪০ সালের ২রা জুলাই প্রথম প্রকাশ। সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত এই জার্নাল জোশুয়া মার্শম্যান ও জন ক্লার্ক মার্শম্যান সাহেবের হাত ধরে নিয়মিত বেরোলেও পরে রেঃ জন রবিনসন দায়িত্ব নেন।
শ্রীরামপুর আসলে ছাপাখানা আর হরফ নির্মাণের শহর। বাঙালীকে শিক্ষিত করে তোলবার শহর। বিলেত থেকে একটি নতুন দেশে এসে ন্যুনতম প্রশাসনিক ক্ষমতা ছাড়া কেবলমাত্র ব্যক্তিগত উদ্যোগে শ্রীরামপুর মিশনারীদের প্রতিটা পদক্ষেপ আজও শ্রীরামপুর শহরের বুকে একএকটা মাইলস্টোন। শহরের ইতিউতি ছড়িয়ে আছে জীবন্ত ইতিহাস। গঙ্গার ধার বরাবর উইলিয়াম কেরী রোড সংলগ্ন জননগর ব্যপটিস্ট গীর্জা আজও বহন করে চলেছে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের কর্মব্যস্ত দিনগুলোর কথা। ঠিক তার বিপরীতেই ফাঁকা জায়গা খ্রীষ্টান ভজনালয় ও প্রথম বাঙালী ধর্মান্তরিত খ্রীষ্টান কৃষ্ণ পালের দীক্ষাগ্রহণের স্থান। রাস্তা বরাবর আর একটু এগোলেই ঐতিহাসিক শ্রীরামপুর কলেজ ভবন। এছাড়াও কোর্ট চত্ত্বরে বড়সাহেবের কুঠি, ড্যানিশদের সেন্ট ওলাভ গীর্জা, ডেনমার্ক ট্যাভার্ন আজও সেইদিনের ইতিহাস স্মরণ করায়। যতই ঘুরে বেড়াই, ততই অবাক করে শ্রীরামপুর। কলকাতার ইতিহাস নিয়ে কত গবেষণা, কত বই, কত কাজ। অথচ ঊনবিংশ শতকের জীবন্ত জীবাশ্ম শহর শ্রীরামপুর আজও কিছুটা অবহেলিতই। কত বাঙালী চেনেনই না বাংলা ভাষার হরফ ও ছাপাখানার আঁতুড়ঘরটুকু। তবু শ্রীরামপুর যেমন ছিল, ঠিক তেমনই থাকবে। শত শত ফ্ল্যাটবাড়ির আগ্রাসন শহরকে ঘিরে ফেললেও আজও জিটি রোডের ধারে কালীতলায় মিশনারী সমাধিক্ষেত্রে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছেন শ্রীরামপুরের তিন কর্মযোগী পুরুষ কেরী, মার্শম্যান আর ওয়ার্ড সাহেব। আর তাঁদের সাথেই শোয়ানো রয়েছে ঊনবিংশ শতকের সম্পূর্ণ শ্রীরামপুর শহরটা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।