কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব – ৩

বাংলার ভুঁইয়াতন্ত্র
দিল্লির সিংহাসনে আকবরের অভিষেক হবার পর তিনি বারবার চেষ্টা করেছেন বাংলায় অধিকার কায়েম করতে। কিন্তু যখন তিনি সিংহাসনে বসেন, অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা কোনভাবেই মুঘল সম্রাটদের শাসনাধীন ছিল না। তখন পাঠানদের দ্বারা শাসিত ছিল বাংলা বিহার সমেত এই বিশাল অঞ্চল। শেরশাহের পর তাঁর পুত্র শলিম শাহ যখন সিংহাসনে বসেন, তখন বাংলার শাসক ছিলেন মোহাম্মদ খাপুর৷ কিন্তু তারপরে বহু বিদ্রোহের ফলে পাঠান বংশজাত সুলেমান করনানি বাংলা বিহারের নবাব নিযুক্ত হন। সময়টা ১৫৬৪ সাল। অর্থাৎ বাদশা আকবর তখন দিল্লির সিংহাসনে বসেছেন। সেই সময় করনানি গৌড় অধিকার করে তাণ্ডা নগরীতে রাজধানী স্থাপন করেন। এক্ষেত্রে সকলের প্রথমে আসে সুলেমানের বিশ্বস্ত সেনাপতি কালাপাহাড়ের নাম। জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হিন্দু হলেও, পরে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে তিনি চরম হিন্দুবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। তারপর থেকেই উড়িষ্যা আক্রমণ করে বিভিন্ন মন্দির বিধ্বস্ত করতে শুরু করেন। তার শক্তিবলে কামরূপ প্রদেশও মুসলমান শাসনাধীন হয়েছিল। এরপর ১৫৭২ সালে সুলেমানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বয়াজিদ খাঁ বাংলার স্বাধীন নবাব বলে নিজেকে ঘোষণা করেন। যদিও তার কিছুদিন পরেই তাঁর ভাই দাউদ খাঁয়ের হাতে তাকে নিহত হতে হয়। বাংলার মসনদে দাউদ খাঁ এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। সম্রাট আকবর বারবার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর সময় বাংলায় শাসন কায়েম করবার। ক্ষমতাবলে দাউদ খাঁও খুব একটা কম ছিলেন না। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে আকবরের সঙ্গে তার লড়াই আজও মুখে মুখে প্রচলিত। সবশেষে দাউদ খাঁয়ের পরাজয় হলেও বাংলার মসনদে তার বীরত্ব সর্বজন স্বীকৃত।
বাংলার অধিকার হাতে ছিল না বলে প্রথম থেকেই সম্রাট আকবর বাংলা দখলের একটা চেষ্টা করতেন। তার আগে বাবর বা হুমায়ূনের পক্ষেও এই কাজটি সম্ভব হয়নি। কারণ বাংলার মসনদে একাধিপত্ব করা পাঠান রাজবংশের ক্ষমতাও নিহাত কম ছিল না। আর সেদিক থেকে দেখতে গেলে মুঘল পাঠান দ্বন্দ্বের সেই শুরু। যদিও পাঠান শাসনকর্তারা মুঘলদের আধিপত্য মেনে নিতেন বরাবরই এবং তাদের ক্ষমতা সম্বন্ধেও ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু তাও মুঘলদের কর প্রদান তারা করতেন না। ১৫৭২ সালে একবার বঙ্গ প্রদেশ জয় করবার জন্য আকবর বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ঠিক সেই সময়ই সুলেমান করনানির মৃত্যু হয় এবং তাঁর দ্বিতীয় পুত্র দাউদ সিংহাসনে আরোহন করেন। বাংলার বিরুদ্ধে আক্রমণ করবার সময়ে স্বয়ং আকবর বাদশা একবার পাটনা পর্যন্ত এগিয়ে এসে সাত দিন সেখানে অবস্থান করেছিলেন। দাউদ খাঁ বাংলা ছেড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। দাউদের অনেক অনুচর এবং হাতি বাদশার হাতে বন্দি হয়েছিল। যদিও স্বয়ং দাউদ খাঁকে ধরা সেইবার মুঘলদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেনাপতি মুনেম খাঁ এবং রাজা টোডরমল অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে বন্দি বানাতে পারেননি। কিন্তু পাটনা বিজয়ের সাথে সাথে সমগ্র বিহার প্রদেশ বাদশাহের অধীনতা স্বীকার করেছিল। কিন্তু এখানেই দাউদ খাঁয়ের গল্পটা শেষ নয়। কয়েক বছর পরে তিনি আবার বিদ্রোহী হয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে সরাসরি কার্যকলাপে লিপ্ত হন। এরপরে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর ও জলেশ্বর এর মধ্যবর্তী একটি স্থানে মুঘলদের সঙ্গে দাউদ খানের ভয়াবহ যুদ্ধ হয় এবং দাউদ খান পরাজিত হয়ে উড়িষ্যায় পালিয়ে যান। এরপর সেনাপতি মুনেম খাঁ গৌড়ের রাজধানী স্থানান্তর করেন এবং বাংলাকে মুঘল শাসনাধীন অঞ্চলে পরিণত করেন। কিন্তু অন্যদিকে বঙ্গদেশ আক্রমণের জন্য দাউদ খাঁ সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকেন। এবং সেনাপতি মুনেম খাঁর মৃত্যুর পর দাউদ আবার বাংলা আক্রমণ করেন। তখন রাজা টোডরমল বাংলায় নেই। আর ঠিক সেই সুযোগটাই দাউদ নিয়েছিলেন। কিন্তু বাদশাহের বীর সেনাপতি হোসেন কুলি খাঁ সেই পর্যায়ে দাউদকে পরাজিত করেন এবং তার ছিন্নমস্তক বাদশার কাছে পাঠিয়ে দেন। এই ছিল বাংলার পাঠান নবাব দাউদ খাঁয়ের সঙ্গে বাদশা আকবরের সরাসরি শত্রুতার গল্পটা। যদিও মুঘল সেনাপতি হোসেন কুলি খাঁয়ের মৃত্যু হলে পাঠান কোতুল খাঁ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। যার নামে আজও বাঁকুড়ার একটি শহরের নাম কোতুলপুর।
বাংলার বারো ভূঁইয়াদের গল্প বলতে গেলে প্রথমে সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে একটি সমূহ ধারণা প্রকাশ করতেই হয়। আর সেই ধারণাটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে দিল্লিতে মুঘল বাদশা এবং গৌড়ের সুলতানদের উপর। কারণ দিল্লি এবং গৌড়ের শাসনের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল আমাদের বঙ্গদেশ। বিভিন্ন সময় স্বাধীন নবাবরা এখানে রাজত্ব করলেও বিভিন্ন প্রদেশে ছিল বিশেষভাবে ক্ষমতা সম্পন্ন জমিদারদের রাজত্ব। আর সেই সময় তারা নিজেদের মতো করে শাসন ব্যবস্থা তৈরি করতেন তার শাসনাধীন সেই এস্টেটে।