সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (ইতিহাস কথা, অন্তিম পর্ব)
by
·
Published
· Updated
শ্রীরামপুরের কথা
স্বাধীনতার পরে খুব তাড়াতাড়ি ভোল বদলায় ঐতিহাসিক শ্রীরামপুর। তখন ভারতের একসময়কার অন্যতম সুন্দর শহর শ্রীরামপুরকে চেনাই দায়। কোথায় আর গঙ্গার তীরে সুসজ্জিত ইউরোপীয়ান বাড়ি, কোথায় খোলামেলা উদ্ভিদ উদ্যান। চারদিকে জুটমিল তৈরি হবার সঙ্গে সঙ্গে জনবিস্ফোরণের মতো আছড়ে পড়তে থাকলো ভিনরাজ্যের মানুষ। উড়িষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্য থেকে কাজের টানে ছুটে এলো দলে দলে মানুষ। আর দেশভাগের পরে তার সঙ্গে যুক্ত হল উদ্বাস্তুর ভিড়। মুহূর্তে বদলে গেল শ্রীরামপুর। অসংখ্য মানুষের ভিড়ে শহর প্রায় হারাতে বসলো তার আদি শ্রী রূপ৷ দিকে দিকে গড়ে উঠলো কলোনি। আজও এখানকার বিভিন্ন পাড়ায় ভিনরাজ্যের অধিবাসীরা বংশপরম্পরায় বাস করছেন।
শোনা যায় মিশনারী কতৃক তৈরি করা প্রেসের কাগজ তৈরির বাষ্পীয় কল ছিল আজকের বটতলা চত্ত্বরের আশেপাশে। রামচন্দ্র দে কতৃক নির্মিত দে স্ট্রিট আজও ধরে রেখেছে কত ঐতিহাসিক স্মৃতি। একদিন সকলের চোখের জলে সেখান দিয়েই হেঁটে গেছে কেরী মার্শম্যান সাহেবের শেষযাত্রা। কিন্তু কোথায় আজ তার অস্তিত্ব। আজকের বটতলা, দে স্ট্রিট শুধুমাত্রই ব্যস্ত ও ঘিঞ্জি জনবিস্ফোরণের সাক্ষী। যেন সকলে মিলে গলা টিপে ধরেছে আস্ত শহরটার। কবে আর ইতিহাসকে বুকে ধরে রেখেছি আমরা। শুধুমাত্র উল্লেখ করবার বিষয় হল ডেনমার্ক ন্যাশনাল মিউজিয়াম ও শ্রীরামপুর পৌরসভার উদ্যোগে আজ নতুন রূপ পেয়েছে কিছু ড্যানিশ সৌধ। ঐতিহাসিক সেন্ট অলাভ গীর্জার সামনে বসানো রয়েছে প্রাচীন ড্যানিশ রাজপুরুষদের ছোট বড় কামানগুলো, যা নিজেদের সৌর্য প্রকাশ করতে একসময় ব্যবহার করত ড্যানিশ কোম্পানি। বড়সাহেবের কুঠি, ডেনমার্ক ট্যাভার্ন ও সেন্ট অলাভ গীর্জার সংস্কার পুনরুজ্জীবিত করেছে আড়াইশো বছর আগের ড্যানিশ স্থাপত্যকে। নতুন করে তৈরি হয়েছে সরকারি ভবনের নর্থগেট ও সাউথগেট। ব্রিটিশদের হাতে শহর প্রত্যার্পণের পর থেকেই এই জায়গায় তৈরি হয়েছে আদালত। বর্তমানে ট্যাভার্নের লাগোয়া গঙ্গার ঘাটে তৈরি করা হয়েছে সুসজ্জিত স্ট্র্যান্ড ও পার্ক। কিন্তু পথ ঘাট থেকে হারিয়ে গেছে বিশপ হেবার সাহেবের সেই ‘কলকাতার চেয়েও বেশি ইউরোপীয়’ শহরটি।
হাওড়া ব্যান্ডেল মেন লাইনের এই গুরুত্বপূর্ণ শহরে আজ যেন তৈরি হয়েছে এক মিনি ভারতবর্ষ। বাংলার রাজনীতিতে ঘোরতর বামপন্থী সময়েও শ্রীরামপুর যেন একখণ্ড দ্বীপ। ১৯৯০ সাল থেকেই সেখানে দক্ষিণপন্থী শাসন। তার কিছু বছর পরে পুরপ্রধান কেষ্ট মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এগিয়ে যায় শহরের নগরায়ন। আজকের নতুন শ্রীরামপুর হুগলী জেলার একটি মহকুমা শহর। প্রতিদিন দলে দলে মানুষ ট্রেনে ও ফেরীতে চড়ে পেশাগত কারণে যাতায়াত করেন এই শহরে। হেঁটে চলার পথে আজকের নিত্যযাত্রীর ভিড় হয়ত একবার চেয়েও দেখে না ড্যানিশ বড়সাহেবের বাড়িটার দিকে অথবা সেন্ট অলিভ চার্চের ঘড়িটার কাঁটায়। কেউ জানতেও চায় না দেয়ালের বিপরীতে চাপা পড়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা। অথচ শোনা যায় কিংবদন্তী কবিগায়ক অ্যান্টনি ফিরিঙ্গীও মাঝেমধ্যে উপাসনা করতে আসতেন এই ড্যানিশ গীর্জায়। কেরী সাহেবের সাধের শ্রীরামপুর আজ প্রোমোটারিরাজের কবলে। জায়গায় জায়গায় উঁচু বহুতল ও বিপণী। পুরপ্রধান কেষ্ট মুখার্জীর সময়ে তৈরি হওয়া স্টেশন সংলগ্ন সুপার মার্কেটে আজ লেগেই রয়েছে নিত্য কেনাকাটার ভিড়। হুগলী জেলার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে আজ শ্রীরামপুরই দ্বিতীয় কলকাতা। সময় এগিয়ে যায় তার গতিধারাতেই। থেমে থাকে না কারও অপেক্ষায়। থেমে নেই শ্রীরামপুরও। প্রতিদিন আধুনিকতার ভিড়ে গা ভাসিয়ে সে পরিবর্তন করে চলেছে নিজেকে। নগরায়নের তাগিদে হারিয়ে যেতে বসেছে ইতিহাসের জীবন্ত পাতাগুলো। কেরীসাহেবের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ীই আজ মিশনারীর সকল সম্পত্তি ও সৌধ শ্রীরামপুর কলেজের অধীনে সংরক্ষিত। মিশনারী সমাধিক্ষেত্র, ব্যাপ্টিস্ট গীর্জা সমেত সমস্ত ঐতিহাসিক জায়গা কলেজের অধীনে রয়েছে। জাঁকজমকভাবে কলেজের দ্বিশতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শ্রীরামপুর মিশনারীর বিখ্যাত ত্রয়ী কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড সাহেবের আবক্ষ মূর্তি। কলেজের মূল ভবনের পাশেই কেরী লাইব্রেরী ও রিসার্চ সেন্টারে যত্ন করে সংরক্ষিত আছে প্রাচীন শ্রীরামপুরের জীবন্ত সব দলিল। বর্তমানে শ্রীরামপুর কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনে বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগ থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিতভাবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী দান করে চলেছে। কলেজের ধর্মতত্ত্ব বা থিওলজি বিভাগও কেরীসাহেবের ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে স্বনিয়ন্ত্রিত ভাবে আজও ডিগ্রীদান করে আসছে। দক্ষিণ এশিয়ায় থিওলজি বিভাগে এটিই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্ররা নিয়মিত আসেন এখানে আবাসিক হয়ে ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করতে।
আজকের শ্রীরামপুরের প্রয়োজন শুধুমাত্র কয়েকটা সহানুভূতির চোখ আর ইতিহাসপ্রেমীদের আবেগের। রাজবাড়ী থেকে কলেজ, হেনরী মার্টিন প্যাগোডা থেকে মিশনারী সমাধিক্ষেত্রে, সর্বত্রই জীবন্ত জীবাশ্ম রূপে মিশে আছে একটা আদ্যোপান্ত ইউরোপীয়ান শহর। গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেলেও হাজার অনুসন্ধিৎসু মন আজও লোকারণ্য শ্রীরামপুরে সেই ইউরোপীয় নগরটাকেই খুঁজে চলেছে প্রতিদিন।