গল্পে কবিতা চক্রবর্ত্তী

স্বপ্ন

রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। এমনিতেই রাত জেগে পড়ার অভ্যাস আমার বরাবর। তাই ঘুম আসতে আসতে অনেকটাই রাত হয়ে যায়। তার ওপর নতুন জায়গা। সবে মাত্র দিন পনের এসেছি নতুন বাড়িতে। ঘুমটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। আসলে ঘুম না আসা আমার একটা রোগ।
আজও কিছুতেই ঘুম আসছে না। বাবা মাও তাদের ঘরে ঘুমোচ্ছে। কি মনে করে ভাবলাম একটু বাইরে থেকেই ঘুরে আসি। সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দরজায় তালা দিয়ে। একটু বাইরের হওয়া খেয়ে আসি।

বেশ কিছুটা গিয়ে একটা বড় লেকের পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম l পর পর দাঁড়িয়ে আছে ঘুমন্ত বাড়িগুলো । মাঝে মাঝে কুকুরের চিৎকার আর দু’একটা বাইক পাশ দিয়ে যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ঘুমে অচেতন সবাই। অথচ দিনের বেলায় কতরকমের আওয়াজ যে পাওয়া যায়। আবার ভোর হতে না হতেই সবাই জেগে উঠবে। শুরু হবে প্রাত্যহিক কাজকর্ম। যদিও আমার সকাল হয় প্রায় দশটায়। এই সব ভাবতে ভাবতে সিগারেটটাও শেষ হয়ে গেল । ভাবলাম এবার বাড়ি ফেরা যাক।

হঠাৎ একটা বাড়ির দোতলার বারান্দার দরজা খুলে একজন বয়স্ক মানুষ বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। আর এসেই কাঁপা কাঁপা গলায় কাউকে যেন ডাকতে লাগলেন। সব কথাগুলো স্পষ্ট শোনা না গেলেও কিছু কথা বোঝা যাচ্ছিল ভালই। রাতের নিস্তব্ধতা চিরে শুনতে পেলাম করুণ সুরে আকুতি, “তুমি ফিরে এসো… ফিরে এসো….”

চমকেই গেলাম একটু প্রথমে। এ কি রে বাবা! এত রাতে ওই বয়স্ক ভদ্রলোক কাকে ডাকছেন এরকম করে? ভাবলাম বাড়ি চলে যাই। কি দরকার পরের ব্যাপারে জানার। একে তো এই পাড়ায় নতুন এসেছি আমরা। কাউকেই তেমন চিনি না। কিন্তু কৌতূহলী মন আমার। আমি সেই বাড়িটা অবধি পৌঁছনোর আগেই দেখলাম একজন কেউ এসে লোকটাকে একরকম টানতে টানতে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। এবার আমার খুব কৌতূহল আরো বেড়ে গেল। ব্যাপারটা তো জানতেই হচ্ছে। এগিয়ে গেলাম পায়ে পায়ে। বাড়ির সাইডের একটা জানলা দেখলাম একটু খোলা রয়েছে। কেউ দেখছে নাকি দেখে , ভয়ে ভয়েই সেই জানলা দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম ভিতরে সেই বয়স্ক ভদ্রলোক মাথা নিচু করে খাটে বসে আছেন। আর সম্ভবত তার স্ত্রীই হবে, সমানে তাকে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে আর বকাবকি করছে।
–বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে তোমার। কদিন পরে তো ঘাটে যাবে, ছোটবেলার অভ্যাস এখনও গেলনা? রোজ রোজ আমি আর পারিনা। আশেপাশের লোকজনই বা কি ভাবে?
আরো অনেক কিছু কথা বলেই যাচ্ছেন ভদ্রমহিলা। ভদ্রলোক কিন্তু কিছু বলছেন না। শুধু মাথা নিচু করে বসে আছেন। কতক্ষন আর দাঁড়িয়ে থাকবো। মশাও কামড়াচ্ছে। আর দেখলাম ভদ্রলোকও কিছু না বলে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। আমিও বাড়ি ফিরে এলাম।

বাড়ি তো ফিরে এলাম। কিন্তু ফিরে আসার পরও আমার কৌতূহল কিছুতেই যাচ্ছিল না। আমাকে তো জানতেই হবে ব্যাপারটা কি? ওই লোকটা কাকে ডাকেন ওরকম করে? নিশ্চয় কেউ হারিয়ে গেছে, তাকেই ডাকেন। তাহলে ওই মহিলা ওরকম করে কথা শোনালেন কেন?

সকালে উঠেই সাইকেলটা নিয়ে আবার গেলাম ওই বাড়ির সামনে। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। না, কাউকে দেখলাম না। কেউ তো বের হচ্ছে না, বা কেউ বাড়িতে ঢুকছেও না। কি করে জানবো তাহলে? কিন্তু জানতে তো আমাকে হবেই।

কপালে যা থাকে হবে ভেবে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম । কলিংবেল বাজাতে কালকের ওই বয়স্ক ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন। –কাকে চাই?
বললাম, একটু দরকার আছে। কিছু কথা ছিল। আমরা এই পাড়াতে নতুন এসেছি। ওই মোড়ের মাথায় যে নতুন বাড়িটা হয়েছে, আমি সেই বাড়ির ছেলে।

ভদ্রমহিলা ভিতরে আসতে বললেন আমাকে। বসতে বললেন। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। কালকের সেই ভদ্রলোকটিকেও দেখতে পাচ্ছিনা। ভদ্রমহিলা বেশ রাশভারী। কথা কম বলেন। এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বললেন,
–বলো কি দরকার?
জলটা খেয়ে বললাম,
–দেখুন আমরা এই পাড়ায় নতুন এসেছি। কাউকেই চিনিনা। কাল রাতে একটু বেড়িয়েছিলাম পাড়ায়। তারপর তাকে কালকের সব ঘটনা এবং আমার কৌতূহলের কথা সব বললাম।

আমার কথা শুনতে শুনতে ওনার মুখে মৃদু হাসি দেখলাম। তারপর উনি যা বললেন, আমি তো অবাক হয়ে গেলাম।
— উনি আমার স্বামী। আমাদের কোনো সন্তান নেই। উনি রিটায়ার করেছেন অনেক বছর। পেনশন পান। বিয়ে হয়ে এসে থেকে দেখেছি আমার স্বামীর ভীষণ সিনেমার নেশা। আর কোনো কিছুর নেশা নেই। ওই একমাত্র নেশা সিনেমা দেখা। হিন্দি বাংলা যে সিনেমাই হোক, প্রথম দিন প্রথম শো ওনার দেখা চাইই। আমিও অনেক সিনেমা দেখেছি ওনার সাথে। ভালই লাগত একটা সময়। কিন্তু ওনার মত নেশা আমার ছিল না। তাই পরে আমি আর যেতাম না। কিন্তু উনি দেখতেনই। এই নেশাটা রিটায়ার করার আগে পর্যন্ত ছিল। কিন্তু আগের মত এত ছিলনা। আজকালকার সিনেমা ওনার ভালো লাগতো না। তাই অনেক বছর আর সিনেমা হলে যান না। শুধু টিভিতে পুরোনো বই হলেই উনি দেখতে বসে যান। আর যে চ্যানেলগুলোতে পুরোনো সিনেমা দেখায়, আমার বাড়িতে শুধু সেই চ্যানেলগুলোই সারাদিন চলে ওনার জন্য। সেই যৌবন বয়েস থেকে উনি মধুবালার খুব বড় ফ্যান। মধুবালার জন্য নাকি উনি পাগল হয়ে গেছিলেন এক সময়। আমার ননদরা এটা বলে আমাকে কত ইয়ার্কি করতো। তবে ওনার মুখেও মধুবালার রূপের, তার অভিনয়ের প্রশংসা আমি রোজ শুনতাম। প্রথম প্রথম রাগ হলেও একসময় বুঝেছি উনি কত বড়ো ফ্যান মধুবালার। আমিও মধুবালার ফ্যান হয়ে গেছিলাম ওনার দেখে দেখে। এখন যেটা হয়েছে, মানসিক একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে ওনার। খুব সাধারণ জিনিস ভুলে যাচ্ছেন। মনে রাখতে পারছেন না অনেক কিছুই। যদিও এই বয়েসে এটা হতেই পারে ডাক্তারবাবু বলেছেন। কিন্তু আর সব ভুললেও মধুবালার কথা কিন্তু উনি একদিনের জন্যও ভোলেননি। এখন রোজ নাকি ওনার স্বপ্নে মধুবালা আসে। অবশ্য কোনো কোনোদিন সেই সময়ের অন্য নায়িকারাও নাকি ওনার স্বপ্নে আসে। উনি মধুবালার সাথে কথা বলেন। গল্প করেন। আর যা হয়, বয়েস হয়ে গেলে তো মাঝে মাঝেই রাতে ঘুম ভেঙে যায়। তাই সেই গল্প করতে করতে যখন ঘুমটা ভেঙে যায়, সাথে সাথে নায়িকারাও চলে যায়। আর তাই উনি ঘুম ভাঙলেই তাদের খোঁজে বারান্দায় বেরিয়ে যান ওদের ডাকতে ডাকতে।
কথাগুলো বলেই উনি নিজেই হেসে উঠলেন। বললেন ,
— এই পাড়ার সবাই জানে ব্যাপারটা। তোমরা নতুন তো তাই জানতে না। ঠিক আছে তুমি বসো। আমি চা নিয়ে আসি। খেয়ে যেও কিন্তু।

আমি তো হাঁ করে ওনার কথা শুনছিলাম। এরকম ফ্যান তো আমি কোনোদিন শুনিনি। আর এই বয়সেও উনি অনেক কিছু ভুলে গেলেও মধুবালার কথা ঠিক মনে রেখেছেন। সত্যিই মধুবালা বেচেঁ থাকলে কত খুশি হতেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *