কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব – ৭

বাংলার ভূঁইয়াতন্ত্র

আজ বলবো আর এক মহাপ্রতাপশালী ভূঁইয়ার গল্প। তার কাহিনীর সঙ্গে যে অঞ্চল জড়িয়ে আছে তা হল মল্লভূম। আজকের বিষ্ণুপুর। বাংলার উর্বর অঞ্চলের রাজারাজড়াদের নাগালের বাইরে সে এক বিশাল অরন্য অধ্যুষিত স্বাধীন রাজ্য। রাজা আছে, সিপাই আছে, আছে অস্ত্র-শস্ত্র, পাইক, বরকন্দাজ। এমনকি বিখ্যাত কারিগর জগন্নাথ কর্মকারের নিজে হাতে তৈরি কামান। মুর্শিদাবাদের নবাবী নজরের বাইরে সে এক হিন্দুরাজাদের বিচরণভূমি। ভৌগলিক সীমানায় নবাবের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও বিস্তীর্ণ জঙ্গলের কারণে নবাব কখনোই ফিরে তাকাননি এই অঞ্চলের ত্রিসীমানায়। এমনকি নিয়মিত নবাবকে কর দিলেও মুর্শিদাবাদের দরবারে কখনো হাজিরা দিতে হয়নি মল্লভূমের রাজাদের। যদিও একজন প্রতিনিধি রাখা থাকতো নবাবের দরবারে।

যাই হোক, ফেরা যাক ঘটনায়, ৬৯৪ খ্রীস্টাব্দে রাজা আদিমল্লের নিজেহাতে প্রতিষ্ঠিত রাজপাট। সেযুগের দুর্ধর্ষ মল্লযোদ্ধা হিসাবে তাঁর দিগ্বিদিক খ্যাতির কারণে মল্লরাজ নামেই লোকে বেশি চিনতে শুরু করে তাঁকে। আর এই মল্লরাজদের হাতেই সযত্নে গড়ে উঠতে থাকে মল্লভূম, আজকের বিষ্ণুপুর। সমগ্র রাজত্বকালের সবচেয়ে বাড়বাড়ন্ত দেখা যায় ৪৯ তম রাজা হাম্বীর মল্ল দেবের সময়ে। রাজা হাম্বীর মল্ল ছিলেন পরম বৈষ্ণব। সে কথা না হয় পরে কখনো বলা যাবে। শহরের সমস্ত মন্দির ও স্থাপত্যই প্রায় এই হাম্বীর মল্লের সময় ও তার পরে পরে তৈরি। সম্রাট আকবরের সমসাময়িক রাজা হাম্বীর মল্লের শক্তিশালী রাজ্যপাটের কারণে বীর হাম্বীর নামেই লোকে ডাকতো তাঁকে। বাদশা আকবরের সাথে ছিল তাঁর সুসম্পর্ক। বর্তমানে ওয়াল্ড হেরিটেজ সাইট বিষ্ণুপুর রাসমঞ্চ তাঁর হাতেই নির্মিত। তবে রাজা বীর সিংহ, দুর্জন সিংহ (মদনমোহন মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা), চৈতন্য সিংহ, রঘুনাথ সিংহের হাতেও তৈরি হয় বিভিন্ন চোখ ধাঁধানো পোড়ামাটির স্থাপত্য ও মন্দির৷ তৎকালীন আশপাশের ঘন জঙ্গল ও দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে বহুদূর থেকে পাথর আমদানি ছিল নিতান্তই খরচাসাপেক্ষ। তাই স্থানীয় লালমাটিতে কারুকাজ করে তা পুড়িয়ে মুর্তি নির্মাণ। এটিই হল টেরাকোটা। শ্যামরায় মন্দির, মদনমোহন মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির, জোড়বাংলো, লালজি মন্দির আরো আনাচেকানাচে অজস্র টেরাকোটার স্থাপত্য এর মধ্যে অন্যতম। মন্দিরের গায়ে সুক্ষ্ম রামায়ন মহাভারত এবং মধ্যযুগীয় শিল্পকলা। তাকিয়ে থাকতে হয় অবাক বিস্ময়ে। কোনো যান্ত্রিক পদ্ধতি ছাড়াই শুধুমাত্র হাতের কাজে দেয়ালগাত্রে পাতলা বাংলা ইটের ভিতের ওপর পোড়ামাটির কাজ। প্রতিটা ইটের ফাঁকে যেন লুকিয়ে আছে কত শত বীরত্ব আর শৌর্যের আখ্যান। কান পাতলে আজও অবিকল শোনা যায় কারিগরদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর শৈল্পিক আঙুলে নকসা বোনার শব্দ।

রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে বিষ্ণুপুরে স্থাপিত হবার পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। তখন আটচল্লিশতম মল্লরাজ ধাড়ীমল্ল বয়সের ভারে ন্যুব্জ। যুবরাজ হাম্বীর শৌর্য বীর্যে বেশ উজ্জ্বল। আশেপাশের রাজ্যেও লোকের মুখে মুখে ফেরে তাঁর বীরত্বের কথা। রাজা হবার পর তাঁর বিচক্ষণ রাজনৈতিক বুদ্ধি আর অসীম বীরত্বের গল্প আজও বিষ্ণুপুরের অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়। তবে সে অনেক পরের কথা। ধীরে ধীরে আমরা আলোচনা করব তাঁর সেইসব অমর কাহিনী। এখন আবার ফিরে আসি সেই যুবরাজ হাম্বীরের কথায়। হঠাৎ মোঘলদের চিরশত্রু উড়িষ্যার পাঠান নবাব সুলেমান কররাণির পুত্র দাউদ খাঁ বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে বসেন। যুবরাজ হাম্বীর তাঁর দক্ষ সেনাদল নিয়ে এগিয়ে যান শত্রুদের আটকাতে। প্রথমে দায়ুদ খাঁয়ের নেতৃত্বে লক্ষাধিক সৈন্য দেখে একটু পিছিয়ে যেতে বাধ্য হন বীর যুবরাজ। কিন্তু তারপর নিজেকে গুছিয়ে কৌশলে আছড়ে পড়েন শত্রুদের ওপর এবং দুইপক্ষের প্রচুর প্রাণের বিনিময়ে তিনি পাঠান দায়ুদ খাঁকে পরাস্ত করেন। সেইদিন যুদ্ধের মাঠে জমে যায় মৃতদেহের স্তুপ আর কথিত আছে যুবরাজ হাম্বীর শত্রুদের মুণ্ড থেকে মালা বানিয়ে অর্পণ করেন কূলদেবী মৃন্ময়ী মাকে। শত্রুদমনের সেই জায়গা আজও বিষ্ণুপুরে মুণ্ডমালার ঘাট নামে বহু পরিচিত। এতো গেলো যুবরাজ তরুণ হাম্বীরের কথা। আর রাজা ধাড়ীমল্লের মৃত্যুর পর যখন তিনি সিংহাসনে বসেন তখন তাঁর বীরত্বের কাহিনী যেন শেষই হয় না। তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বুদ্ধি আর দূরদর্শীতায় তিনি মোঘল – পাঠান যুদ্ধে মোঘল পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। সম্রাট আকবরের সাথে সুসম্পর্ক তাঁকে অনেকটা শক্তিশালী করেছিল সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহও নেই। সম্রাট আকবর শাসনের সুবিধের কথা ভেবে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যকে মোট ১৬ টি জায়গীরে ভাগ করেন। তার মধ্যে বাংলার দায়িত্ব পান স্ময়ং রাজপুত সেনাপতি মানসিংহ। একবার সন্ধি করার ফাঁদে ফেলে তৎকালীন পাঠান নবাব কতলু খাঁ মানসিংহের পুত্র জগৎসিংহকে তুলে নিয়ে যান উড়িষ্যায়। স্বাভাবিক ভাবেই বিচলিত হয়ে পড়েন রাজা মানসিংহ। বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বর্তমান আরামবাগের কাছে ছাউনি ফেলেন তিনি। সেই সুযোগে নিজের রাজ্যের মধ্যে মোঘল পাঠান দ্বন্ধে তিনি সেনাসমেত সরাসরি সাহায্য করেন মানসিংহকে এবং প্রায় একক বিক্রমে যুদ্ধ করে ছাড়িয়ে আনেন জগৎসিংহকে এবং বন্দী অবস্থায় হত্যা করে সমাধিস্থ করেন কতলু খাঁকে। সেই স্থানটিই আজ কতলু খাঁয়ের নাম অনুযায়ী বর্তমান বাঁকুড়ায় কোতুলপুর নামে খ্যাত। যুদ্ধের পরে স্বাভাবিক ভাবেই মোঘলদের সুনজরে পড়ে যায় সেযুগের বন-বিষ্ণুপুর (বিষ্ণুপুরের তৎকালীন নাম)। এমনকি সেদিন বাদশার দরবারেও হাম্বীরের হয়ে বহু প্রশংসা করেছিলেন রাজা মানসিংহ। কৃতজ্ঞতাবশত বিষ্ণুপুরের ওপর থেকে করের বোঝা পর্যন্ত তুলে নিয়েছিলেন বাদশা আকবর। প্রায় ৫০০ বছর আগেও মল্লভূমের মত জঙ্গল অঞ্চলে তাঁর দক্ষ শাসনব্যবস্থার সুবিধার জন্য এক একটি দৃঢ় পদক্ষেপ আজকের মানুষকেও অবাক করে। দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থার সুবিধার জন্য তিনি সমগ্র মল্লভূম জুড়েই উঁচু উঁচু স্তম্ভ তৈরি করেছিলেন। শত্রু আক্রমণের খবর এতে তাঁর কাছে অনেক আগেই খুব সহজে পৌঁছে যেত। এই স্তম্ভগুলোকে তখন বলা হত ‘মাচান’। আজও বাঁকুড়ায় কোনো কোনো জায়গায় এইসব স্তম্ভের ভাঙা অংশ দেখা যায়। বাঁকুড়া স্টেশনের কাছে ‘মাচানতলা’ অঞ্চলের নামকরণের কারণও এটিই। যদিও নাম থাকলেও এই অঞ্চলের মাচানটি বহুকাল আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *