সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ৫)
by
·
Published
· Updated
কলকাতার ছড়া – ৫
আর যাই হোক, প্রথম প্রথম কলকাতায় জমিদারী পাবার পর ইংরেজ কোম্পানি চট করে প্রজাদের খেপাত না। সঠিক খাজনা সময় মতো মিটিয়ে দিলে আর তেমন কোনও চাহিদার বালাই নেই। তারা থাকত নিশ্চিন্তে তাদের হোয়াইট টাউনে। আর দেশীয় প্রজারাও নিজেদের মত করে গুছিয়ে নিচ্ছিল ধীরে ধীরে। জমিদারী লাভের পর কোম্পানি ঘোষণা করল, কলকাতায় থাকবেন একজন স্বাধীন প্রেসিডেন্ট আর তার অধীনস্থ এক কাউন্সিল। বাংলার বাণিজ্য কুঠি গুলো তারই অধীনে থাকবে। কলকাতার প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন স্যার চার্লস আয়ার। স্বল্পদিন পরে তিনি দেশে ফিরে গেলে প্রেসিডেন্ট হন জন বায়ার্ড। তিনি বহুদিন কলকাতাবাসী। তাই এ শহরের হালহকিকত তার বিলক্ষণ জানা। কলকাতায় দূর্গ (ফোর্ট উইলিয়াম) নির্মাণের স্বপ্ন তাঁর মস্তিষ্ক প্রসুত বলেই জানা যায়।
তো এহেন বিলিতি জমিদারীতে তখন দিগ্বিদিক থেকে দলে দলে মানুষ আসার ঢল পড়ে যায়। সে এক অদ্ভুত কাণ্ড। প্রতিদিনই সারে সারে মানুষ আসেন কলকাতায় আর গড়ে তোলেন বসতি। এর মূল কারণ ছিল দেশীয় রাজন্যবর্গের অত্যাচার। ইংরেজদের কলকাতায় আর যাই হোক, খাজনাটুকু দিয়ে দিলে দুমুঠো খেয়ে শান্তিতে থাকা অন্তত যায়। আর নতুন জমিদারীতে কাজের অভাবও নেই। এই কথার প্রচলন হয়ে গেছে সারা বাংলায়। কলকাতা প্রেসিডেন্সী কোম্পানির বিলেতের ডিরেক্টরের পর্যন্ত খুব একটা তোয়াক্কা করত না। তাদের সব কাজে ডিরেক্টররা খুশি না থাকলেও কলকাতা যে তার গুরুত্ব দেয় নি, তা তাদের হাবভাবেই বোঝা যেত। এমনকি ১৩০০ টাকায় বড়িশার রায়চৌধুরীদের থেকে তিনখানা গ্রাম কেনার সিদ্ধান্তেও ডিরেক্টররা শিলমোহর দেন নি। এ কেবলমাত্র কলকাতাস্থিত সাহেবদের ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীর ইচ্ছের ফল।
তবে জমিদারী লাভের পর যত শহরে লোক আসতে থাকে তত দায়িত্ব বাড়তে থাকে কোম্পানির। রাস্তা তৈরি, জঙ্গল সাফাই, ধর্মস্থান নির্মাণ এইসব কাজই শুরু হয় দ্রুতগতিতে। এখনকার লালবাজারের কাছে ছিল তৎকালীন কাছারী বাড়ি৷ জমিদারীর আয়তনের সাথে সাথে বাড়তে থাকল খাজনাও। বিশেষ করে ১৭৪১ সালের পরে বাংলায় বর্গী আক্রমণ হলে বহু দেশীয় পরিবার পালিয়ে আসতে থাকেন কলকাতায়। বিলিতি জমিদার কোম্পানি যে ততদিনে এদেশের মানুষের মনে একটা বিশ্বাসের জন্ম দিতে পেরেছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এমনকি বর্গী মারাঠাদের হাত থেকে নিজেদের শহর ও প্রজাদের রক্ষা করবার জন্য তারা পুরো কলকাতাকে ঘিরে খাল খনন পর্যন্ত করেছিল। যদিও এই খরচের অনেকটাই কলকাতার বাঙালী ধনী সম্প্রদায় বহন করেছিল। একেই বিখ্যাত মারাঠা ডিচ বলে অভিহিত করা হয়। আজও বাগবাজারে মারাঠা ডিচ লেন এই খালের স্মৃতি বহন করে চলেছে। তর্কসাপেক্ষে শোনা যায় আজকের টালিনালা নাকি এই খালেরই একটি অংশ।
যাই হোক, আজব শহর ছিল কলকাতা। সেকালে এটি ছিল প্রধানত ব্যবসার স্থান। দেশ ছেড়ে লোক কলকাতায় ছুটত দুমুঠো অন্ন ও কাজের আশায়। সেই উপলক্ষে মুখে মুখে কথিত ছিল-
“ধন্য হে কলিকাতা ধন্য হে তুমি |
যত কিছু নূতনের তুমি জন্মভূমি ||
দিশি চাল ছেড়ে দিয়ে বিলাতের চাল |
নকলে বাঙালী বাবু হল যে কাঙাল ||
রাতারাতি বড়লোক হইবার তরে |
ঘর ছেড়ে কলিকাতা গিয়ে বাস করে ||”