সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (ইতিহাস কথা পর্ব – ২৩)
by
·
Published
· Updated
শ্রীরামপুরের কথা
১৮৪৫ সালের ১১ই অক্টোবর ড্যানিশরা বাধ্য হয়ে ইংরেজদের কাছে বিক্রি করে দিল তাদের সাধের ফ্রেডরিক্সনগর৷ ১৮৬৫ সালে ভিলেজ কমিটি ভেঙেগড়ে ব্রিটিশরাই তৈরি করলো শ্রীরামপুর পুরসভা৷ ধীরে ধীরে ব্রিটিশ ভারতের অঙ্গ হিসাবে আধুনিক বর্তমান রূপটি পেতে শুরু করলো এই শহর৷ তখনই শ্রীরামপুর আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে তার শিল্পনগরী চেহারায়। ব্রিটিশদের হাতে নগর প্রত্যার্পণের পর উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ইন্ডিয়া জুটমিট তৈরি। দেশের একটি অস্থির অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বহিঃরাজ্য থেকে প্রচুর মানুষ শ্রীরামপুর শহরে ঘাঁটি গাড়লে গড়ে ওঠে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই জুটমিল। শ্রীরামপুর কলেজের পাশে পড়ে থাকা বিশাল জমিতে তৈরি হয় এই শিল্প কর্মকাণ্ড। শোনা যায়, এই জুটমিলের জমিই নাকি একসময়ে কেরীসাহেবের প্রিয় উদ্ভিদ উদ্যান। কিন্তু বারংবার বন্যা ও ঝড়ে এই উদ্যান শ্রীহীন হবার ঘটনা আমরা আগে আলোচনা করেছি। স্বভাবতই কেরীর মৃত্যুর পর এই জমি অব্যবহৃত অবস্থাতেই থেকে যায়৷ আজকের ইন্ডিয়া জুটমিলের চত্ত্বরেই ঐতিহ্যবাহী শ্রীরামপুর জননগর ব্যাপ্টিস্ট গীর্জাটি দাঁড়িয়ে আছে যা প্রাচীন মিশন ছাপাখানা ও কেরী মার্শম্যান এবং ওয়ার্ড সাহেবের প্রথম বাসভবনের স্মৃতি যত্ন করে ধরে রেখেছে। হুগলী নদীর তীরে জুটমিল প্রসঙ্গে বলে রাখি, ১৮৫৫ সালে রিষড়ায় গঙ্গাতীরে জর্জ অকল্যান্ড সাহেব স্কটল্যান্ডের ডান্ডি জুটমিল থেকে মেশিন এনে ভারতের প্রথম জুটমিলটি তৈরি করেন। যে জমির উপর তৈরি হয় এই শিল্পাঞ্চল, এক সময় সেটি দাপুটে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বাগানবাড়ি ছিল বলে জানা যায়।
১৮৫৪ সালে ইংরেজ বাহাদুরের উদ্যোগে হাওড়া থেকে হুগলী পর্যন্ত রেলপথ চালু হলে শিল্প মানচিত্রে শ্রীরামপুর এক উল্লেখযোগ্য স্থান করে নেয়। ১৯১৪ সালে শ্রীরামপুর পৌরসভা নগরবাসীকে পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহ শুরু করে। আর ১৯৩৮ সালে শহরে জ্বলে ওঠে বৈদ্যুতিক আলো৷ ঘরে ঘরে পৌঁছনো শুরু করে বিদ্যুত। শ্রীরামপুরের কথা বলতে গেলে যার কথা না বললেই নয় তা হল টেক্সটাইল কলেজ। ১৯০৮ সালে একটি ভাড়া বাড়ির ঘরে বস্ত্রবয়ন শিক্ষায় দু বছরের সার্টিফিকেট কোর্স পরিচালনার জন্য শুরু হয় এই কলেজ। তারপর ১৯৫৭ খ্রীস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনে স্নাতকস্তরে পড়াশোনা শুরু। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনে দেওয়া হয় বিভিন্ন বিভাগে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী। পুরনো ড্যানিশ গর্ভমেন্ট হাউস বর্তমানে কোর্ট এবং ড্যানিশ বড়সাহেবের কুঠিটিই আজকের মহকুমা শাসকের বাংলো। গঙ্গাতীরে ডেনমার্ক ট্যাভার্নের লাগোয়া বাংলো থেকে মহকুমা পুলিশ অধিকর্তা দেখভাল করেন সমগ্র শ্রীরামপুর তথা উত্তরপাড়া, কোন্নগর, রিষড়া সমেত হুগলী জেলার একটি বৃহত্তর অংশ।
শ্রীরামপুর প্রসঙ্গে বলতে গেলে প্রাসঙ্গিক ভাবে এসে পড়ে চাতরা গ্রামের কথা। যদিও সে আর আজ গ্রাম নয়৷ তবু একসময়ের চাতরা গ্রাম ছিল বৈষ্ণব শাস্ত্র চর্চার মধ্যমণি৷ কারণ চৈতন্য পার্ষদ স্বয়ং কাশীশ্বর পণ্ডিতের বাসভূমি এই চাতরা গ্রাম। একেবারে জঙ্গল কেটে নিজে থাকবার ঘর তৈরি করেন তিনি। চৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশেই নিজেহাতে কৃষ্ণমন্দির প্রতিষ্ঠা করে সেখানেই নিয়মিত দেবসেবা শুরু করেন কাশীশ্বর৷ রাধাবল্লভ জিউ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে আমরা আগেই কাশীশ্বর পণ্ডিত ও তাঁর ভাগ্নে রুদ্ররামকে জেনেছি। পরে তিনি এখানে গৌরাঙ্গ ও বিষ্ণুপ্রিয়া মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করেন। আজও দোলমঞ্চের সেই মন্দিরপ্রাঙ্গনে মিশে আছে কাশীশ্বরের স্মৃতি। বর্তমানে চাতরার চৌধুরী পরিবারই তাঁর বংশের উত্তরপুরুষ। চাতরা ছিল সংস্কৃত টোল ও চতুষ্পাঠীর জন্য প্রসিদ্ধ। দিগ্বিদিক থেকে ছাত্ররা ছুটে আসত পণ্ডিতের কাছে শাস্ত্র পড়তে। ড্যানিশ সময়ে ধীরে ধীরে চেহারা বদলে শহরের রূপ নিতে শুরু করে এই বর্ধিষ্ণু গ্রাম। তৈরি হয় পাকা রাস্তা। এরপর ইংরেজ আমলে ১৮৭৩ সালে তৈরি হয় ইংরাজি স্কুল। যা আজকের বিখ্যাত চাতরা নন্দলাল ইন্সটিটিউশন। ১৮৭৯ সালে স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত। পরে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেন। বরিশালে তাঁর নেতৃত্বে স্বদেশ বান্ধব সমিতির ছত্রছায়ায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বাংলায় শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত চাতরা নন্দলাল স্কুল আজও নিমগ্নচিত্তে বাঙালী যুবকদের তৈরি করে চলেছে অনবরত। এই স্কুলে শিক্ষকতা করে যান স্যার নীলরতন সরকারের মতো ব্যক্তিত্বও।
ড্যানিশ ঔপনিবেশিক সময় থেকে প্রায় ৩০০ বছর পার করেও শ্রীরামপুর আছে সেই শ্রীরামপুরেই। আজও হয়ত উইলিয়াম কেরী রোড ধরে হেঁটে গেলে জননগর ব্যাপটিস্ট গীর্জার ভেতর থেকে স্পষ্ট শোনা যায় ছাপাখানার যন্ত্রচালিত শব্দ, আবার কোর্টচত্ত্বরে ইভিনিং ওয়াকের সময়ে দেখা যায় ড্যানিশ রয়াল চার্টারের স্মারক। এমনই জীবন্ত জীবাশ্ম শহর আজকের শ্রীরামপুর। এখান থেকে প্রতিদিন রেলের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ যাত্রী নিয়মিত পৌঁছে যান কলকাতার উদ্দেশ্যে। হাওড়া ব্যান্ডেল রেলপথে একটি উল্লেখযোগ্য স্টেশন এটি। ট্রেন থেকে নামলেই চোখে পড়বে মাহেশের মন্দিরের আদলে নির্মিত বিশাল টিকিট কাউন্টার আর রাজা কিশোরীলাল গোস্বামীর ঐতিহাসিক কাছারিবাড়ি (বর্তমানে শ্রীরামপুর পৌরভবন)। গঙ্গার ঠিক উল্টোদিকেই সেনাশহর ব্যারাকপুর। নিয়মিত নৌকা চলাচলের মাধ্যমে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত প্রাচীন এই দুটি নগরী। প্রতিদিনের ব্যস্ত শ্রীরামপুরে হয়ত আজও সেই মায়াদৃষ্টিতেই চেয়ে থাকেন সর্টম্যান, কর্নেল ও বাই, উইলিয়াম কেরী, জোশুয়া মার্শম্যান, কাশীশ্বর পণ্ডিত, রুদ্ররাম পণ্ডিত, রাজা কিশোরীলাল গোস্বামী, রামচন্দ্র দের মতো এই শহরের প্রাণপুরুষরা।