ছোটদের জন্যে বড়দের লেখায় কুবলয় ব্যানার্জী (ছোটগল্প)

প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়মের স্টোর রুম থেকে ১৯৭০- এর দশকে পাওয়া যায় ফাইলটা । নাম দেওয়া হয় – le dosière sécrèt বা গোপন নথি । তাতেই প্রথম বার নাম জানা যায় এই গুপ্ত সংগঠনের । Priory of Scion । বিভিন্ন সময়ে যাঁরা এই সংগঠনের গ্র্যান্ড মাস্টারের পদে থেকেছেন, তাঁদের নাম শুনলে আঁতকে উঠতে হয় ।
রবার্ট বয়েল, সার আইজ্যাক নিউটন, সান্দ্রো বত্তিচেল্লি, লেওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ভিক্তর উগো ইত্যাদিরা । নথির বয়ান অনুযায়ী এই সংগঠনের শেষ গ্র্যান্ড মাস্টার প্রখ্যাত ফরাসি নাট্যকার জ্যঁ ককতো । ইনি ১৯৬০-এ মারা যান । এর পর কার হাতে এই সংগঠনের দায়িত্ব বর্তায়, গোপন নথি তা বলেনি । স্বভাব অনুযায়ী চুপ ইতিহাসও ।
কেঁচোর খোঁজ করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে বড় বড় কেউটে । ১১ শতাব্দীর রহস্যময় টেম্পলার নাইটদের সম্পর্কে বহু অজানা তথ্য প্রকাশ পেতে থাকে । মনে করা হয়, ১৩০৭-এ ফ্রান্সে এই নাইটদের ঝাড়ে বংশে শেষ করে ফেলা হয়েছে বলে মনে করা হলেও তা হয়তো সত্যি নয় । লড়াকু এই নাইটদের পেছনে যে একটা অত্যন্ত চতুর ‘মগজ’ কাজ করত, আজ তা নিয়ে সংশয় নেই ।
সেই মগজ সংগঠনই Priori of Scion
ইতিহাস বলে, ১৩০৭-এর ১৩ অক্টাবর ভোররাতে দক্ষিণ ফ্রান্সের লাংদোক অঞ্চলে টেম্পলারদের কাসলে হামলা করেল ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ । বহু নাইট মারা পড়েন । গ্রেপ্তার করা হয় গ্র্যান্ড মাস্টার জাক দ্য মুলাই-কে (Jacques de Mulay) । কিন্তু, ফিলিপ সেই সময়ের পোপ ষষ্ঠ ক্লেমেন্টের নির্দেশে হামলা করেও যা খুঁজছিলেন তা পাননি ।
কী ছিল সেই জিনিস ?
রাজা বা পোপ নিজেও জানতেন না । ধরা পড়া গ্র্যান্ড মাস্টারকে পরের সাত বছর কাসল অফ শিনোনে অমানুষিক অত্যাচাক করেও কিছু জানা যায়নি ।
১৩১৪ সালে জনসমক্ষে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় জাক দ্য মুলাইকে । আলতো আঁচে, কাপড়ে মুড়ে । একটু একটু করে । না, তখনও কিচ্ছু বলেননি তিনি । শুধু পোপ ক্লেমেন্টকে মর্মান্তিক অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন, ‘ছ’মাসের মধ্যে নরকে দেখা হবে ।’
ফাঁকা আওয়াজ দিতে অভ্যস্ত ছিলেন না গ্র্যান্ডমাস্টার । ছ’মাস লাগেনি । একমাস পরই ‘কলেরায়’ মারা গেলেন পোপ । অন্য উপসর্গের মধ্যে ছিল অসহ্য পেটের যন্ত্রণা । যারা চিকিতসাশাস্ত্র জানতেন, তাঁরা জানতেন কলেরায় পেটব্যথা হয় না । পেটের যন্ত্রণা বাদ দিলে কলেরার সঙ্গে লক্ষণগুলো হুবহু মিলে যায় শেঁখো বিষের সঙ্গে । বুঝতে কষ্ট হয়নি কারও যে, গ্র্যান্ডমাস্টারের হত্যার বদলা নিতে খোদ পোপের খাবারে আর্সেনিক মেশানোর ব্যবস্থা হয়েছিল । এটাই ছিল সংগঠনের অনুপ্রবেশের ক্ষমতা ।
১৯০৬-৭ সালের ঘটনা । দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের রনে ল্য শাতো নামে এক অখ্যাত গ্রামের গির্জার পাদ্রি হয়ে এলেন এক তরতাজা যুবক – বেরঁজে সোনিয়ের । নামগুলো মনে রাখা প্রয়োজন । এই নামগুলো ঘুরেফিরে এসেছে দ্য দা ভিঞ্চি কোড বইতে । ল্যুভরের কিউরেটরকে এই পদবীই দিয়েছিলেন ড্যান ব্রাউন ।
যমের দক্ষিণ দুয়ারে পড়ে থাকা এই গ্রামে যুবক সোনিয়েরের কিছুই করার ছিল না । পিরেনিজের জঙ্গলে শিকার আর পাশের গ্রামের গির্জার ফাদারের থেকে ল্যাটিন শিখে সময় কাটাতেন তিনি । একদিন বাই চাপল নিজের ভেঙে পড়া (ঐতিহাসিক dilapidated শব্দটা ব্যবহার করেছেন) গির্জাটা নিজেই সারাতে বসলেন ।
সেই সময়ই গির্জার প্রধান বেদীটা সাফাই করতে গিয়ে দেখলেন, পাথরের একটা স্ল্যাব নড়ছে । সেটা খুলতেই দেখলেন ভেতরে নামার মত জায়গা রয়েছে । সেখানে নামার পর বহু খুঁজেও একটা ছোট প্যাকেট ছাড়া কিছুই পেলেন না তিনি ।
গুপ্তধন না পাওয়ায় হতাশ হয়েছিলেন সোনিয়ের । হেসেছিলেন ভাগ্যদেবতা । রাতে ওই প্যাকেট খুলে ভেতরের পুথিটা বের করে পড়তে শুরু করেন । একদিন পরে কাউকে কিছু না বলে সোজা চলে যান প্যারিস । সেখান থেকে জীবনে ও শেষবার ভ্যাটিকানে ।
প্রায় একমাস পরে ফিরে আসেন ওই গ্রামেই । ঢালাও মেরামতি করান গির্জার । সংলগ্ন এলাকায় একটা প্রাসাদ তৈরি করান নিজের জন্য । কোথা থেকে পয়সা আসে বছরে চার পাউন্ড বেতন পাওয়া এই যাজকের – তা কেউ জানেন না । সোনিয়েরের ছায়াসঙ্গীনি এবং পরিচারিকা ১৮ বছরের মেরি দোনারনোও কাউকে কিছু বলেননি । তিনিও লোকজনের সঙ্গে মেশা বন্ধ করে দেন ।
নতুন তৈরি গির্জার তোরনে সোনিয়ের লিখিয়ে দেন – terribilis est locus ist । অর্থাত – this place is terrible । ওই তোরনেই বসান হয় এক গ্রিক উপকথার রাক্ষসের মূর্তি । আমাদের কুবেরের মতো, সম্পদ রক্ষা করাই ওই রাক্ষসের কাজ ।
কী লেখা ছিল ছিল ওই পুথিতে ?
সেটা কেউ জানেন না । তবে ওই আবিষ্কারের পর সোনিয়েরের চালচলন বদলে গিয়েছিল । শোনা যায় তিনি বেশ কিছু রহস্যময় লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন ।
তাঁর গ্রামের প্রাসাদে অনেকে আসতেন, যাঁদের মুখ দেখা যেত না । ঘোড়ার গাড়ি সরাসরি ভেতরে চলে যেত ।
যে প্রাসাদ তিনি বানিয়েছিলেন, সেখানে একটা বিশাল উঁচু লাইব্রেরি করেছিলেন । নাম দেন – Tour Magdala বা ম্যাগডালেন টাওয়ার । এ সেই মেরি ম্যাগডালেন, যাঁকে চার্চ বার বার ‘দেহোপজীবিনী’ বলে খাটো করার চেষ্টা করেছে ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।