গারো পাহাড়ের গদ্যে জিয়াউল হক (মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা)

আমি এম, আশরাফ আলী খলিফা, এফ,এফ.
এফ.এফ.নম্বর – ৭৭৫২, গেজেট নম্বর – সুজানগর-১৮০৬, লাল মুক্তিবার্তা নম্বর – ০৩১১০৬০১৫৮, এমআইএস নম্বর – ০১৭৬০০০ ১৪৯৮, মোবাইল নম্বর – ০১৭১১২৪৭৫১৬,
পিতা: গোলাম হোসেন খলিফা, মাতা: আঞ্জুমানআরা,
স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম: গোপালপুর, ডাকঘর: নাজিরগঞ্জ, উপজেলা: সুজানগর, জেলা: পাবনা।
বর্তমান ঠিকানা: মিরপুর ডিওএইচএস, বাড়ি নম্বর – ২৮০, রোড নম্বর – ৪, এডিনিউ নম্বর – ৩, মিরপুর, ঢাকা – ১২১৬।
১৯৭১ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। ঢাকা তখন উত্তাল আন্দোলনে ভাসছে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা কোন মতেই বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি ছিল না। তাইতো নানা অযুহাতে শুরু হয় সময়ক্ষেপনের খেলা। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আহুত জাতীয় পরিষদের অঠিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার সাথে সাথেই বাংলাদেশের আপামর জনগণ বিপুল আক্রোসে রাস্তায় নেমে এসে প্রবল গণআন্দোলন শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিক্ষোভে সারা ঢাকা শহর কেঁপে ওঠে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভার ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ”এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম” উল্লেখ করার সাথে সাথে বাঙালিরা যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠলো। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা এবং বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালির মনোজগতকে আগেই প্রস্তুত করে রেখেছিল।এবার সেখানে স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ রুয়ে দিলেন। নিভর্ীক আন্দোলন, মিছিলে ঢাকা শহর প্রকম্পিত হলো।
এই আন্দোলনে কার্যকরী অবদান রাখতে ৭ মার্চের পরই ঢাকা ছেড়ে আমি আমার ছাত্রজীবন ও রাজনৈতিক জীবনের তীর্থক্ষেত্র রাজবাড়িতে চলে আসি। ওখানেই স্কুল জীবনে আমার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সেখানে এসে আমরা যুবক ছেলেরা সংগঠিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার কাজ শুরু করি। শুধু তাই না, রাজবাড়ি রেলওয়ে মাঠে প্রাক্তন সেনাবাহিনীর সদস্য হাবিলদার আব্দুল বারী মোল্লার নেতৃত্বে প্যারেড, পিটি এবং রাতের বেলায় জঙ্গল প্যারেড শুরু করি। প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে আমরা স্থানীয় ভাবে দেশীয় বন্ন্দুক সংগ্রহ করে তার চালনা কৌশলও রপ্ত করি।
২৫ মার্চ রাতে পাকসেনারা ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের উপর আক্রমণ করে বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ ও নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে। এই ঘটনার প্রতিবাদে আমি ও সন্টু ভাই ২৭ মার্চ রাজবাড়ি চিত্রা সিনেমা হল থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে পদদলিত এবং তাদের জিন্নাহর ছবি ভাংচুর করি। এতে স্থানীয় রাজবাড়িস্থ বিপুল বিহারিদের দারুন প্রতিক্রিয়া হয়। জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য স্থানীয় গণপরিষদ সদস্য কাজী হেদায়েত হোসেন এবং মোসলেম মৃধার নেতৃত্বে এ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এক ভাগ সিভিল প্রশাসন ও অন্যভাগ সামরিক বিষয়গুলি দেখাশুনা করতেন। ঢাকা থেকে আরিচা হয়ে পাকসেনারা রাজবাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে এই সংবাদ পেয়ে গোয়ালন্দ ঘাটে তাদের বাধা দেওয়ার জন্য সামরিক কমিটি আমাদের সেখানে প্রেরণ করেন। আমরা গোয়ালন্দ ঘাটে অবস্থান গ্রহণ করে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। কিন্তু তাদের মর্টারের গোলার মুখে টিকতে না পেরে আমরা পিছু হটে আসার পর শত্রুরা বিনা বাধায় রাজবাড়ি শহরে প্রবেশ করে। পাকসেনাদের আগমনের পর বিহারিদের আচরণের দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। তারা তখন পাকসেনাদের সাথে যোগ দিয়ে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার কাজে লিপ্ত হয়।
আমি ও সন্টু ভাই পাকিস্তানের পতাকা পদদলিত ও জিন্নাহর ছবি ভাংচুর করায় সহজেই তাদের টার্গেটে পরিণত হই এবং শহরে থাকা বিপদজনক হয়ে ওঠে। ফলে আমরা শহর ছেড়ে বালিয়াডাঙ্গা থানার পদমনি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলাম। সেখানে কয়েক দিন থাকার পর মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের পথে যাত্রা করলাম। বেলগাছি রেল স্টেশনে এসে বকু চৌধুরী নামের আমার এক দাদার সাথে দেখা হলো। ট্রেনযোগে দর্শনা হয়ে যাওয়া অনেক ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় বকু দাদার পাসশি নৌকাযোগে ভারতের পথে যাত্রা করে কুষ্টিয়ার প্রাগপুর বর্ডার পেরিয়ে আমরা ভারতে প্রবেশ করে কলকাতা গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে আমি আমাদের পূর্ব পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতা ফনিভূষণ মজুমদারের সাথে দেখা করি। তিনি আমাদের কয়েকজনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে রাজনৈতিক মোজিভেশনের কাজ দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে এই কাজ করতে আমার মোটেও ভালো লাগছিল না। আমারর প্রবর ইচ্ছা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। মায়ের সাথে দেখা না করেই সরাসরি ঢাকা থেকে ভারতে চলে এসেছি। যুদ্ধে যাবার আগে মায়ের আর্শ্বিাদ নিতে আমার মন উতরা হয়ে উঠলো।
তাই মায়ের সাথে দেখা করার জন্য কাউকে কিছু না বলে বাংলাদেশের ভেতরে পাবনা জেলার সুজানগর থানার নিজ গ্রামে এলাম আমি। গ্রামে এসে দেখতে পেলাম পাবনার ইকবাল ভাই, বিশু ভাই, হেলাল ভাই ও সন্টু ভাই মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষন নিয়ে ইতোমধ্যেই চলে এসেছেন। তাদের সাথে যোগদান না করে মায়ের সাথে দেখা করেই আমি আবার ভারতে প্রবেশ করে নদীয় জেলার কেচুয়াডাঙ্গা ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগদান করি। সেখান থেকে মালদা জেলার গৌড়বাগান হয়ে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের শিলিগুড়ির পানিঘাটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়। সেখানে প্রথমে ২১ দিনের গেরিলা প্রশিক্ষণ ও ১৪ দিনের লিডারসীপ প্রশিক্ষণ শেষে আমাকে প্লাটুন কমান্ডার মনোনীত করা হং। ৩ সেকশনের মোট ৩৩ জন যোদ্ধা ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আরও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তুফানি ব্যাটেলিয়ন নামে একটা ব্যাটেলিয়ন গঠন করা হয়। আমি এই ব্যাটেলিয়নের ডেল্টা কোম্পানীতে অন্র্Íভূক্ত হই। আমাদের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ইগনাস ক্যাশ্যপ। ব্যাটেলিয়ন গঠন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হওয়ার পর ৭ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার তরঙ্গপুর থেকে আমরা অন্ত্র গোরাবারুদ সংগ্রহ করি।
কয়েক দিনের মধ্যেই তৎকালীন রাজশাহী জেলার ফার্সিপাড়া পাকসেনা ক্যাম্পে আক্রমন পরিচালনা করি। ওটা ছিল আমাদের জীবনের প্রথম যুদ্ধ। ২ দিনের যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করি। অতঃপর ভারতীয় বাহিনীর পাশাপাশি দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি রেল স্টেশন, রংপুর জেলার পলাশবাড়ি, গোবিন্দগঞ্জের যুদ্ধে পাকসেনাদের পরাজিত করে আমরা বগুড়া শহরের উপকন্ঠে এসে হাজির হই। বগুড়া ছিল শত্রুদের ডিভিশন হেডকোয়ার্টার। সেখানে তারা বিপুল শক্তি নিয়ে অবস্থান করছিল। তাই ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ দিন উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলার পর অনেক জানমালের ক্ষতি স্বীকার করে শত্রুরা আমাদের নিকট অত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। জীবন বাজি রেখে যে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি, সে দেশের আকাশ, বাতাস, মাটি, সামান্য ধূলিকণাও আমার জীবনের চেয়ে বেশি প্রিয়।
”জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী”।