গারো পাহাড়ের গদ্যে জিয়াউল হক

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শাহজাহান আলী
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শাহজাহান আলী, এফ.এফ. এফ.এফ.নম্বর-৩০১০, লাল মুক্তিবাতার্ নম্বর-০৩১২০৪০০৪৩, এমআইএস নম্বর-০১৮৮০০০০৪০৮, মোবাইল নম্বর-০১৭৫৩৪৯৬৩৪৬, পিতা – মোকসেদ আলী সরকার, মাতা – বুলু খাতুন, স্থায়ী ঠিকানা – গ্রাম – কুটি সাতবাড়িয়া, ডাকঘর – খাস সাতবাড়িয়া, উপজেলা – শাহজাদপুর, জেলা – সিরাজগঞ্জ। বর্তমান ঠিকানা – ঐ।
বাবা মায়ের ৪ ছেলে ২ মেয়ে সন্তানের মধ্যে শাহজা্জান আলী ছিল সবার বড়। ১৯৭১ সালে তিনি তৎকালীন পাবনা জেলার শাহজাদপুর থানার খাস সাতবাড়িয়া হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষার জন্য তিনি পড়াশুনায় ভীষণ সিরিয়াস ছিলেন। কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসা তাকে পড়ার টেবিল থেকে একেবারে যুদ্ধের মাঠে নিয়ে এলেন। ছাত্র জীবন থেকেই শাহজাহান আলী ছিলেন প্রতিবাদী যুবক। সাথে সাথে তিনি দেশকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পরও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সময়ক্ষেপন করতে থাকেন। শুধু তাই না জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করার পরও ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পূনরায় তা স্থগিত ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণায় বাংলাদেশের আপামর মানুষ রাস্তায় নেমে এসে প্রচন্ড গণআন্দোলন শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক বিশাল জনসভায় নীতিনির্ধারণী ভাষণ প্রদান করেন। তিনি তার ভাষণে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুদের মোকাবেলার আহবান জানান। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়েই শাহজাহান আলী মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনারা সারা বাংলাদেশের উপর আক্রমণ করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে বাঙালিরাও প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করেন। দুপক্ষের যুদ্ধের মধ্যে দেশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। তাই এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে শাহজাহান আলী ভারতের পথে যাত্রা করেন। তারপর ভারতের নদীয়া জেলার কেচুয়াডাঙ্গা যুব শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে বেশ কিছু দিন অবস্থান করার পর শাহজাদপুর এলাকার এমপিএ আব্দুর রহমান তাদের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার পতিরামপুর ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে ১৫ দিন অবস্থান করার পর জুন মাসের মাঝের দিকে উচ্চতর প্রশিক্ষনের জন্য বাছাই করে শাহজাহান আলীদের শিলিগুড়ির পানিঘাটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে ২৮ দিন প্রশিক্ষণ শেষে তরঙ্গপুর হয়ে তাদের সরাসরি তৎকালীন রাজশাহী জেলার সোনা মসজিদ সীমান্তে প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে তাদের ধোবড়া-কানসাট ডিফেন্সে পাঠানো হয়। ডিফেন্সে নদীর পূর্ব পাড়ে শত্রুদের অবস্থান এবং পশ্চিম পাড়ে ছিল শাহজাহান আলীদের অবস্থান। প্রায় প্রতিদিনই শত্রুদের সাথে গোলাগুলি হতো। একদিন শত্রুসেনাদের কাউন্টার এ্যাটাকে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলে তারা্ মাহাদীপুর ক্যাম্পে ফিরে আসেন।
মাহাদীপুর ২/৩ দিন অবস্থান করার পর শাহজাহান আলীসহ ৩০/৪০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে দিনাজপুরের বিরল থানার মুক্তা লে প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে তাদের আবার পাশের পলাশবাড়ি ডিফেন্সে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তাদের ডিফেন্সের সামনেই ছিল শত্রুসেনাদের পাকা বাঙ্কার। ৩ দিন পর হঠাৎ করেই শত্রুসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর এলোপাথারী সেলিং করতে শুরু করে। সেই সেলিং থেকে জীবন বাঁচাতে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে আসতে বাধ্য হয়। সেদিন শত্রুদের আক্রমণে আমিনুল হক চুন্নু নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও সেলের স্প্লিন্টারের আঘাতে আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুস সাত্তার কুদরতী ও সফিউর রহমান নামের ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মক ভাবে আহত হয়। পলাশবাড়ি ট্রাজেডির পর সকল মুক্তিযোদ্ধাদের ৭ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার তরঙ্গপুর ফিরিয়ে এনে আব্দুস সালামের নেতৃত্বে একটা মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ গঠন করে আসামের মানকার চর হয়ে শাহজাহান আলীদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করা হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে তারা শাহজাদপুর থানার রতনকান্দিতে সেল্টার গ্রহণ করেন।
তালগাছি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ঃ রাজাকাররা রাতের বেলায় নগরবাড়ি বগুড়া সড়কের তালগাছির পাশের একটা ব্রিজে পাহারা দিত। আব্দুল সালামের নেতৃত্বে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা রাতের বেলায় পাহারারত রাজাা্র ক্যাম্পের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে ২ জন রাজাকারকে হত্যা এবং ২টি রাইফেল উদ্ধার করে। তাছাড়াও এই মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপটি আশেপাশের আরও বেশ কয়েকটি রাজাকার ক্যাম্পের উপর আক্রমণ করে তাদের অনেক জানমালের ক্ষতি সাধন করে। ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা উল্লাপাড়া থেকে পরাজিত হয়ে নগরবাড়ি ঘাটের দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল, সেই সময় এই গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা গুলি বর্ষণ করতে করতে শত্রুদের পিছু ধাওয়া করে। কিন্তু শত্রুসেনারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এটাই ছিল তাদের সর্বশেষ অপারেশন। শত শহীদের রক্ত আর শাহজাহান আলীদের মতো অকুতভয় মুক্তিযোদ্ধাদের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়েই আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই জাতীর এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আমাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া উচিৎ।