হৈচৈ ছোটদের গল্পে জয়তী চট্টোপাধ্যায়

নীলের অনুভব
রবিবার। বৈঠক খানায় নীলের বাবা, মা, কাকা, কাকাই সবাই বসে। জোরদার আড্ডা চলছে।
হঠাৎ নীল ঢুকেই প্রশ্ন করে,” আচ্ছা তোমরা কেউ কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটা দেখেছ!”
” না রে, দেখিনি। জানিনা সম্ভব কী না!”
বাবার কথার উত্তরে নীল বলে ” তাহলে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কেন লিখেছেন… ভোর হল রে ফর্সা হল, দুলল ঊষার ফুল দোলা,আনকো আলোয় যায় দেখা ওই পদ্ম কলির হাই তোলা..”
সবাই নিশ্চুপ। শুধু নীলের কাকা বললেন, ” ওটা কবি কল্পনা!”
এই এক কবিতা পাগল প্রকৃতিপ্রেমী ছেলে হয়েছে।
পড়াশোনায় কিন্তু বেশ মন আছে। মায়ের কাছে পড়ে। ফাঁকি দেয় না একেবারেই।
সেবার অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পরে দেখা গেল অঙ্ক, বিজ্ঞানে ফুল মার্কস।বাংলা, ইংরেজিতেও ভাল নম্বর। কিন্তু ভূগোল আর ইতিহাসে সত্তর আর বিয়াল্লিশ।
মা বললেন ,” এমন হওয়ার তো কথা নয়। সব ও জানত।”
নীলকে ডেকে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন,” কী হয়েছিল রে , পড়া হয়নি!”
” সব জানা ছিল বাবা।কিন্তু ইতিহাস পরীক্ষার দিন হঠাৎ জানলা দিয়ে দেখলাম মেঘের দল ছুটেছে না জানি কোন দেশে। কেউ পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে, কেউ কানাকানি করতে করতে আবার কেউ শুধুই ভেসে চলেছে। ছটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পরে কলম গেল থেমে।মনে পড়ে গেল… মেঘেরা দল বেঁধে যায় কোন দেশে ও আকাশ বল আমাকে।”
কাকা কাকাই বলে উঠলেন,” আস্ত কবি একখানা!”
ওর বাবা চোখ রাঙিয়ে বললেন,” আর ভূগোল পরীক্ষায়!”
” জানো বাবা আমাদের ক্লাসের পাশেই একটা কৃষ্ণ চূড়া গাছ আছে। বাতাসে ফুলগুলো লুটোপুটি খেয়ে মাটিতে পড়ছিল আর মাটিটা লাল ফুলে ফুলে একেবারে রাঙা হয়ে যাচ্ছিল। উফ্ কী সুন্দর যে লাগছিল! কিন্তু বাবা আমি তো মাত্র দুটো প্রশ্ন ছেড়েছিলাম ভূগোলে!”
বাবা মায়ের মন খারাপ হলেও ওর কাকা, কাকাই কিন্তু নীলের সম্পর্কে প্রচণ্ড আশাবাদী।
ভাল কবিতা দেখলে সঙ্গে সঙ্গে মুখস্থ করে ফেলে। কাকাই আদর করে ডাকেন প্রকৃতিপুত্র।
সেদিন হঠাৎ নীল প্রশ্ন করল,” আচ্ছা কাকা অমলকান্তি কেন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!”
কাকা পড়লেন বিপাকে। বললেন,” তোর বাংলা ম্যাম ভাল বলতে পারবেন।
দাদু, ঠাম্মা এলেন পুজোর ঠিক আগে।
নীলের প্রচুর প্রতিমা দেখা হল, জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হল সকলের সঙ্গে।
বিসর্জনের পরে ওদের বিশাল উঠোনে একটা অনুষ্ঠান হয়। পাড়ার সবাই মিলে। সেবার হল নটির পূজা। উদ্বোধনী সঙ্গীতের পরে নীলের আবৃত্তি।
কিন্তু ও কী বলছে! কেউ তো শোনেনি এমন কবিতা। সূর্য, চন্দ্র, তারা,আকাশ, বাতাস, ফুল পাখি, দূর্বাদল, আগমনী সব মিলেমিশে একাকার। কী অপূর্ব বাচন ভঙ্গি! যেন এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া, যেন আঁচল ভরা শিউলি ফুল। কবিতার নাম অনুভব। কবির নাম তো বলল না।
নীলের বাবা আর মা খুব চিন্তিত। কী হবে ছেলের! উঁচু ক্লাসে উঠছে। পড়াশোনা তো করতেই হবে।
দাদু অভয় দেন,” এটা কোনো চিন্তার ব্যাপার! শিখছে তো সব। কিন্তু লিখতে গিয়ে কোনোদিন হয়তো আকাশ বাতাস ওকে হাতছানি দেয়.. ও আনমনা হয়ে পড়ে। ভাবিস না। ওইটুকু ছেলে এমন কবিতা ভালোবাসে, এমন প্রাণ ভোলানো আবৃত্তি করে… বিশাল ব্যাপার। একটু বড় হোক সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ছুটতে ছুটতে এলো দশ বছরের নীল।
” দাদু, তোমার জন্য আমার পুজোর উপহার। নেবে তো!”
” পাকা বুড়ো, নিশ্চয়ই নেব।”
নীল দাদুকে দেয় একটা নোটবই।
” দাদুভাই, এইসব কবিতা তোর লেখা! ভাবতেই পারছি না!”
কিছু কবিতা দাদু পড়ে শোনালেন। তার মধ্যে অনুষ্ঠানের সেই কবিতাও ছিল।
সবাই মুগ্ধ, বিস্মিত।
” আর কিসের চিন্তা। আমার নাতির কবিতার বই প্রথম আমি বের করব। নীল পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে মস্ত বড় কবি হবে। ”
খুশিতে ডগমগ সব্বাই ।
ঠাম্মা গাল ফুলিয়ে বললেন,” দাদুর জন্য এমন উপহার আর আমার কিচ্ছু না!”
” দাঁড়াও। দশ মিনিট।”
দশ মিনিট কাটল না। হাতে কাগজ নিয়ে নীল ঢুকল।
“ঠাম্মা আমার মা দুর্গা/ ঠাম্মা আমার সোনা/ নীলের হৃদে চলে তোমার নিত্য আনাগোনা।
যেতে তোমায় দেব নাকো/ থাকবে এখানেতে/ ঘুমপাড়ানি গান শোনাবে/ শীতল পাটি পেতে।
সব্বাই খুশি। দাদু, ঠাম্মা,বাবা মা, কাকা কাকাই সবাই। ছোট্ট নীলের কাছ থেকে এমন এক অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিতে।
Apurbo laglo.