T3 নববর্ষ সংখ্যায় জয়িতা ভট্টাচার্য

ঘাটের কথা
এক একটা দিন সাদা থান গায়ে পরে নেয় ইন্দ্রানী।ধপধপে সাদা আর লাল নরুণ পাড়।আশপাশ দিয়ে রঙিন সম্পর্কগুলো দেখে কত দূর পেছনে আরও পেছনে চলে যাচ্ছে।এমন সব দিনে বেদনার গায়ে লেগে যাওয়া ধুলো মুছে নেয় ইন্দ্রানী শ্বেত আঁচল দিয়ে।ওর সামনে বিরাট বাড়িগুলো পথ আটকে দাঁড়ায়,কিল বিল করে গোখরো সাপের মতো ট্রামলাইন।সেসব ছেড়ে পা ডুবিয়ে বসে বাগবাজারে মায়ের ঘাটে।
দুপাশে ভেসে এসে জমা হয়েছে সবুজ গুল্ম।গঙ্গার স্রোতে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কের মতো কচুরি পানা,ঝরা ফুল।সন্ধ্যার আলোয় নরম আলোয় কান পাতলে বাতাসের সঙ্গে কথা হয় ঘাটে বসে,
__”যে অল্পে তুষ্ট থাকে তার কাছে পৃথিবীর সব কষ্ট সহজ হয়ে যায়” ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ভেসে আসে জলজ বাতাসের স্বর।যেদিন সাদা শাড়িটা গায়ে থাকে ইন্দ্রানী সেদিন বাগবাজারে থাকে।সারা শহর বাগবাজার হয়ে যায়।
মনে মনে বলে,’এত করি তবু মন কেন পাই না’…কান্না পায়। ভেঙে পড়ে।তবুও আসে স্নিগ্ধ বাতাস।ঘাটে বসে দূরে দেখা যায় সেতু।এপার-ওপার করে। মা বলতেন,
“কেউ যদি তোমাকে খারাপ দুঃখ পেও না কারন এক জীবনে সবার কাছে ভাল হওয়া যায় না।” ইন্দ্রানী ফিরে তাকায় পেছনে,।ক্লান্ত।বিষন্ন। সংসার-প্রেম-সারা জগত যেন তাকে ছিবড়ে করে ফেলেছে। আর এখন এই গোধূলীতে এক আশ্চর্য নারী নরম আলোর মতো পাশে বসেছে এসে। শীতল হয়ে যাচ্ছে উষ্ণ মন,
“যখন তুমি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছ, থেমো না, চলতে থাকো ভালো সময় তোমারও আসবে।” কানে কানে বলে যায় এক অলীক নারী।
দু ফোঁটা জল চোখ থেকে গড়িয়ে যায়।ডুকরে ওঠে মন_মা!
সাদা শাড়ি নতুন শব্দ শেখায়।ভিড়ের ভেতর একা থাকার দীক্ষা দেয়।জল কাঁচের মতো স্থির,ঢেউ ওঠে না আর।শান্ত হয়ে আসে সব আলোড়ন।এরকম সময় বিকেল জলে মেশে।আকাশ সব রঙ তার ঢেলে দেয় জলে।শ্বেত রঙের পাড়ে নরুন পাড় লাল হয়ে যায় ঢেউ।
যেন আসক্তির ঘাট।ওটুকু থাক।দেহ থাকলে যেটুকু থাকতে হয়।ইন্দ্রানীর মধ্য জীবনের প্রণয়।বিরহে ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে মন।সিঙ্গল মাদার।
মা ছাড়া কাকে বলা যায় কষ্ট।ইহলোক পরলোকের মা। মা সারদা,সারদামণি।
“যে সয় সে রয়”।মায়ের কন্ঠ ভেসে আসে পাখির ডাকে।দূরে ডিঙি নৌকা,কচুরি পানা ভেসে যায়।
মায়ের বাড়ি আরতির শব্দ শোনা যায়।এবাড়িতে মূর্তি নেই।মায়ের শোবার ঘর।দু একটি ছবি।কিছু মানুষ নিথর বসে।ভাবেন।মন সাদা করেন।সবাই আত্মারামের সন্ধান করে।বেশিরভাগই পায় না ।খুব একজন দুজন পায়।।
বাতাস বলে,”ভালোবাসলে সব হয় জোর করে কায়দা করে কিছু কাউকে দিয়ে করানো যায় না।”
ঘাটের কাছ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে নৌকা।শিল্যুট।
“সত্য হলেও অপ্রিয় কথা বলতে নেই ” মা বলতেন সংসারে থাকতে গেলে দোষ দেখো না।
ইন্দ্রানী সাদা শাড়িটা আর রঙ করে না।বাস্তবজীবনে কর্মস্থলে সংসারে বা প্রেমে সর্বত্রই যে একথা সত্য মা কিভাবে বলতে পারলেন সেই অমোঘ সত্য। সামান্যা গ্রাম্য সেই নারী!
আসক্তির লাল শাড়ি ভাসিয়ে ইন্দ্রানী নদীতে শাড়ির খুঁটে বেঁধে নেয় ধ্রুবতারা।ওরা এখনো পাশাপাশি বসে থাকে।শব্দহীন প্রণয়ে আসা যাওয়া করে।প্রেম যেন বাগবাজারের ঘাট।
ইন্দ্রানী ভাসিয়ে দেয় লখিন্দরের ভেলা।
“ভালোবাসায় সব হয়,জোর করে কায়দায় ফেলে কাউকে দিয়ে কিছু করানো যায় না” কানে কানে বলে যায় নদীর জল।এভাবেই কেটে যায় কত মুহুর্ত একা।যারা এসেছিল তারা চলে যায়।আঁধার করে আসে।আবার সম্বিত ফেরে মায়ের ডাকে।
মা বলেছেন,” চুপচাপ বসে না থেকে কিছু না কিছু কাজ করবে অলস বসে থাকলে মনে নানা চিন্তা জড়ো হয়”…ইন্দ্রানী উঠে দাঁড়ায় ,পা বাড়ায় যেদিন থেকে আসে আরতির ধ্বনি,শেষ সূর্যের রশ্মী মেখে ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি___মা সারদামণি।
“যদি শান্তি চাও দোষ দেখো না কারো…”।
ইন্দ্রাণী পা বাড়ায় জীবনের দিকে