ঘন শাল,মহুয়া, শিরিষ আর পিয়ালের অরণ্যে আরো একবার হারিয়ে ফেলে দেবলীনা।অদূরে হিংলো নদীর চর।বর্ষা এলে আসে জল।আরো দূর আরো দূরে অজয়ের মোহনা।ছোটোবেলা ফিরে ফিরে আসে।তার গ্রাম তার আপন লোক। তার ধরম “সারি”। মারানবুরু…তাদের দেবতা। জাহিরিয়া, মান্ঝিএঁরাও মান্ণডি দেবতা।
এখনো আসে সে। এসেছে ফিরে দেবলীনা তিনদিনের ছোট্ট ছুটিতে।”বাহা” পরবে। ঐতিহ্যবাহী জনগোষ্ঠী সাঁওতাল। গর্বিত সে এমন জাতিতে জন্ম নিয়ে।ফুলো আর ঝানো মুর্মুর রক্ত তার শরীরে।সাঁওতাল বিদ্রোহের দুই নায়িকার কথা ভারত দেশের কজন জানে। কজন জানে তাদের উৎস ভিয়েতনাম ও খামের উপজাতিগত এস্ট্রো এশিয়াটিক। রজত। রজত এসেছে সঙ্গে। সে আর রজত আজ সারাদিন ঘুরে এসেছে তার কলেজ, বরাগড়ির পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু স্মৃতি মহাবিদ্যালয়।জাম্বানি, বাঁকুড়া শহর তার তত পছন্দ নয় আর। অন্তর্ধান করেছে বণ্য সভ্যতা এসে গেছে বনিক সভ্যতা।
তারা সারাদিন ঘুরেছে তার নয়নাঠল,পলাশডাঙা,জোফলাই, হজরতপুর। রজত জানতে চায় অনেক কথা। তাদের কথা।
পলাশডাঙায় তার ভারি কদর। এখন সাঁওতালি ভাষাভাষী গাঢ় রং,চ্যাপ্টা নাক আর কোকড়ানো চুলের মানুষগুলোকে কদর করে কেউ কেউ।
তবুও ত শহরের বোকা আর মূর্খ মানুষের অবজ্ঞার দৃষ্টিতে ঝরে পরে পরিহাস।
“তোমাকে নদীর মতো লাগে, কুমারী নদী”
হাসে দেবলীনা।” হ্যাঁ কংসাবতী র সবচেয়ে বড় উপনদী। আরো আছে যারা তুমি চেনো না বন্ধুদের।বান্ধু নদী,হনুমন্তজির,সাহারা,হোবারি,চাকনা,এসব কাঁসাইয়ের উপনদী।
রজত পুঁথি পড়া বিদ্যা ফলায় এগুলো বোধহয় পুরুলিয়ার। “আর সুবর্ণরেখার উপনদীও ত আছে ।”
__খুব সুন্দর তাদের নাম। রূপাই, রাড়ভু, সাভা, শঙ্খ নদী।জল থাকে না সব সময়।তবে প্রেমের জোয়ারে কখনো ভাসাবে দোঁহারে, বর্ষাকালে বা বন্যার সময় ” খিলখিল করে হাসে দেবলীনা।
— রূপাই ত তোমারও ডাক নাম।আমি তাই বলেই ডাকব।
–ডেকো।তবে ….
” নিভৃত গোপনে ,তাইত”মুখের কথা কেড়ে বলে রজত।
চামি মুর্মু, যিনি ‘নারী শক্তি ‘ পুরস্কার পেলেন ২০২০ এ তিনি তোমার কেউ হন?
— মুর্মু হলেই কি আমার আত্মীয় হন! শোনো আমাদের বারোটা গোত্র।
হাঁসদা, মার্ডি, সোরেন, টুডু, কিস্কু, বাস্কি, চোরাই, হেমব্রম, গোঁয়ার,বেসরু। আমাদের ভাষা মুণ্ডা।ধর্ম সারি।যদিও ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি আগ্রাসনের কারনে এখন অনেকেই ক্রিশ্চান। কিন্তু আমার সমাজে ,এই সাঁওতাল সমাজ কিন্তু জাতপাতের বৈষম্যহীন এক সাম্যবাদী গোষ্ঠী।
–“তুমি এমন এক সভ্যতা থেকে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছ দশের মুখ উজ্জ্বল করেছ এটা হয়ত তোমার একার নয় তোমার ঐতিহ্যশালী পরম্পরায় নিহিত আছে”
ওরা পরস্পর হাত ধরে ছিল। ওরা সূর্য ডোবা দেখছিল। বৈষম্যহীনতায় প্রকৃতির মাঝে দীর্ঘ চুম্বনের সঙ্গে সঙ্গেই নেমে এসেছিল রাত আর তারপর উৎসব।
আজ দেবলীনা বলে রজত শোনে। ১৯৫৯ তে প্রথম আই এ এস অফিসার জি সি মুর্মু থেকে আজকের কনিষ্ঠতম পার্লামেন্ট সদস্যা চন্দ্রানী মুর্মু সহ দেবলীনার পরিচিতদের কথা উঠে আসে আলোচনায়।
রজত আকাশ দেখে।খোলা আকাশের নীচে প্রেতপুজো হয়।শুভের সঙ্গে অশুভের পুজো।কাল সিং,লকচেরা বা বিউদারং এর পুজো।
রজত জানে সাঁওতাল শব্দটা এসেছে সুঁতার শব্দ থেকে। খুব সমৃদ্ধ সাঁওতালি সাহিত্য অনুবাদ করতে শুরু করেছে রজত এই সন্ত্রাসের সন্ধানের পরিসরে।সে কি দেবলীনা কে ভালোবেসেই!ভালোবেসে এসেছে বাহা পরবে।
দেবলীনা নাচছে।কোমর দুলিয়ে দুলকি চালে।প্রধান তপন কিস্কু বলছে রজতকে মাঘ মাসে হয় বড় করে বাবা বোঙ্গার পরব,সাহরাই, আরো,আসারিয়ার উৎসব ।
অনন্ত হাঁসদা স্টিলপ্লান্টে কর্মরত আরো অনেক সাঁওতালিদের মতোই।তার উৎসাহ রজতকে নিয়ে বৈশাখী পূর্নিমায় শিকারে যাবে “ডিসুমসেন্ন্দ্র” উৎসবে।
এখানে আকাশ এসে মিশেছে মাটিতে এর চাঁদ মেসেজে নদীর জলে।রজত মুগ্ধ হয়ে দেখে দেবলীনা ম্যাডামকে।