T3 || কোজাগরী || বিশেষ সংখ্যায় জয়িতা ভট্টাচার্য

কে জাগে…
কোজাগরী
এমনকি এই সেদিনও দেখেছিলাম পথে।মাথা ভর্তি কালো চুলে আর শেষটা টিকটিকির ল্যাজের মত সরু থেকে সরুতর হয়ে বিলীন।এক বগলে হাঁস আর এক বগলে কুকুর ছানা।হন্ হন্ করে কোনো দিকে দৃকপাত না করে সে চলেছে কোথায় যেন আর তার পেছনে রাজ্যের বাপ খেদানো মায় তাড়ানো তার পোষ্য কুকুর বেড়াল। তারপর এখন আর নেই। নেই মানে একেবারেই নেই। মরে গিয়ে জ্যোৎস্না হয়ে গেছে।
মনে পড়ে তার পরম যত্নে পোষ্যগুলোর মুখে খাবার তুলে দেওয়া। হ্যাঁ, লক্ষ্মী পাগলি।এভাবেই ছোটো থেকে বড়ো হওয়া লক্ষ্মী পাগলির সঙ্গেই।সে একই রকম।পাগলিদের বয়স বাড়ে না। এরকমই কোজাগরী পূর্ণিমার সঙ্গে বড়ো হয়েছি।
লক্ষ্মী মেয়ে কবেই অ-অলক্ষ্মী হয়ে গেছে। পুরুষের হাতের পুতুল হয়ে সারাজীবন মেয়েমানুষের লক্ষ্মী হতে চাওয়া। আল্পনা আর হলুদ,সরার ভেতর কড়ি,থুড়ি,যাবতীয় কামনা বাসনা অভিমান জমা হয়ে থাকে। লক্ষ্মী মেয়ের নেই সঠিক কোনো পরিচয়।
নীহাররঞ্জন রায়ের “বাংলার ইতিহাসে বলেছেন লক্ষ্মী র মূর্তি পুজো সুপ্রচলিত নয় ।শস্যদায়িনী ও সমৃদ্ধি র দেবী ধান,ও ধানের গোলা আলপনা ও ঘট সুসজ্জিত এক নিরাকার কামনা পুজো।
পুরুষ তাকে যখন যেমন রূপ দেয় তেমন সে পূজিত। কখনো দেবসেনারূপে কার্তিকের বউ সতীনসহ কখনো গনেশপত্নী,কখনও নদীরূপে কখনও “শ্রী” রত্নাকরের কন্যা তো কখনও লুব্ধ বিষ্ণুর ইলোপিত নারী।অথচ ফসলের বা উর্বরতার দেবী হিসেবে তো পুজো হতো সরস্বতীর, লক্ষ্মীর নয়!
মানব সভ্যতার প্রধান বিষয়উৎপাদন। সে ফসল হোক বা প্রজনন। অবশ্য লক্ষ্মীর ছেলে পুলেদের নাম ঠিক মনে পড়ছে না।আসলে যার অস্তিত্বই সব সময় নড়বড়ে তাকেই তো লক্ষ্মী বলে!নারী বলে। এই ব্যাপারে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলেছেন,”লক্ষ্মী মানে শ্রী বা সুরুচিঅথবা সুন্দর।যিনি শ্রী রূপে পূজিতা,পরে ঐশ্বর্য দেবতা নারায়ণের অংশ। বৈদিক আমলে একজন ই দেবী অর্থাৎ মহাশক্তি র ধ্যান হতো তিনি ।শ্রী”। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ অবধিও দুর্গা পুজোর সঙ্গে লক্ষ্মী পুজোর কোনো সংযোগ নেই। প্রাচীন কালে অনার্য বা আদি ভূমিপুত্রদের ভূমি দেবী হিসেবে পূজিত।নেই কোনো মূর্তি।একটা কনসেপ্টমাত্র। কামনা আর বাসনার ঘট পরিপূর্ণ করে শস্য সরঞ্জামে পুজো হতো। ক্রমে আর্যরা এসে “নিম্নবর্ণ “দের থেকে কৃষি কাজ শিখে অর্জন করলেন সম্পদ। ক্রমে শাসক ও শোষক হয়ে বসলেন আর তারপর শুরু হয়ে গেল নারীকে দেবী বানানোর এই কায়দা। সম্পদের দেবী ধনদেবী। বিত্ত কে 24×7 পাহারা দিতে দিনে নারী রূপ অর্থাৎ বধূ আর রাত পাহারায় নিশি পক্ষী পেঁচা। লক্ষ্মী বা বিত্ত তো চঞ্চলা হবেই নদীর মতো অর্থনীতির চাকা নাহলে ঘুরবে কেমন করে! সেই যে বিধবা আত্মহত্যা করতে যায় অবন্তীনগরে তার সাংসারিক অশান্তি র জন্য। ফিরে এসে বাসনা দেবীর পুজো করে।আবার ফিরে আসে সচ্ছলতা। এরকম নানা গল্প সমৃদ্ধ করে লোককথা। বিভিন্ন লোকপুরাণের নানা গল্প কোনো মিল নেই একে অপরের।যেমন মূলত শ্রী ও লক্ষ্মী দুজন আলাদা। ভঙ্গুর কন্যা লক্ষ্মী যাঁর মা খ্যাতি। আবার উপপুরাণেও নাস্তানাবুদ লক্ষ্মী। দুর্বাসা মুনি যাঁর কিনা কোনো গুণই নেই শুধু রাগ ছাড়া এমন একটা কাঁচা কাজ করে ফেললেন। হঠাৎ পারিজাত মালা দিয়ে বসলেন ইন্দ্রকে ,তিনি তখন সে মালা নেবার অবস্থায় নেই রম্ভার সঙ্গে জমিয়ে প্রেম করছেন,কী মালা কে দিলো কিছু না দেখেই ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ঐরাবতের গলায়,তা সে হাতি বেচারা মালার মর্ম বুঝবে কী। অতএব মালা ভুলুণ্ঠিত, দুর্বাসা খচে ব্যোম এবং শাস্তি। না ইন্দ্রকে নয় বেচারি লক্ষ্মীর! ইন্দ্রপুরী হতে নির্বাসিত হয়ে পাতাল শেষে সমুদ্র থেকে উত্থিত হওয়া মাত্রই বিষ্ণুর হেফাজতে।হাতে শ্বেত পদ্ম ও অমৃত কলস।আর ওই কলস নিয়ে সুরঅসুরের যুদ্ধ। একেবারে নায়িকানায়কভিলেন স্টোরিলাইন। সীতারাধালক্ষ্মী সবাই মিলে যায় পাশের বাড়ির লক্ষ্মী দির সাথে। পরিপাটি অবনত সুন্দরী ধন দায়হীন,প্রসবিনী লক্ষী। তবু যারা এই গতের বাইরে কিন্তু তারাও তো কোজাগরী পূর্ণিমায় আলপনা আঁকে কামনার। বিত্তহীন অসুন্দর নারী লক্ষ্মী নয়। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর বাংলার ব্রতকথা বইতে বলেছেন লৌকিক এই দেবী ফলনের প্রতীক ,ধান্যশীর্ষপূর্ণ ঘট ও আল্পনা কামনার প্রতিচ্ছবি। ” প্রাচীন ময়মনসিংহ গীতিকাতেও তো পাওয়া যায় লক্ষ্মী র নাম। অবশ্য বাংলাদেশের লক্ষ্মী পুজো ও এই দেশের পুজোর ধরন এক নয়। এ দেশীয় ও অবাঙালিদের লক্ষ্মী তো শ্রী,গনেশ পত্নী, কালীপুজোর দিন পূজিত অলক্ষ্মী বিদায় করে,কুলো বাজিয়ে গোবরের লক্ষ্মী বিসর্জনে। বছরে দুবার ফলন রবি ও খরিফ শস্য মেনে লৌকিক লক্ষ্মী পুজো ভাদ্র মাসে ও পৌষ মাসে। “আঁকিলাম পদ দুটি ,তাই মাগো নিই লুটি
দিবারাত দুটি ধরি,বন্দনা করি মাগো আলপনা এই পূজা বন্দনা”।
লক্ষ্মী আপাদমস্তক লৌকিক। ত্যাগ নয় , বিনাশ নয় মানুষের কামনা বাসনা ও সঞ্চয়ের অতন্দ্র প্রহরী যেন।
ঘরে যে মায়ের কাছে ছেলে,আর স্ত্রীর কাছে স্বামী তার বিত্ত গচ্ছিত রেখে চলে যায় জীবিকার্জনে দূরে।
আজকের লক্ষ্মী নারীরাও এমন একাকী সুন্দর আর সমৃদ্ধ করে তোলেন সংসার নিঃশব্দে।
“আমি আঁকি ধানের গোলা,আমার হোক ধানের গোলা,
আমি আঁকি পিটুলির বালা আমার হোক সোনার বালা।”
লৌকিক কামনা পূরণের জন্য হৈমন্তিকা লক্ষ্মী র এই পূজা এখন সর্বত্র ফলন নয় ফলের আশায়।
পুরুষের কামনা বাসনার রক্ষিতা হয়েও সম্মান একদিন মাত্র।
লৌকিক এইসব পুরাণে লক্ষ্মী এমনকি কখনও ঘোটকি কখনো তুলসী।
মাটির কাছের এক নারী তার সমস্ত কামনা বাসনা আর পার্থিব আসক্তি র নাম লক্ষ্মী।
সারারাত জ্যোৎস্নার আলোয় শম্বুক* শৃঙ্গার সমস্ত বাসনার মালাখানি গলায় নিয়ে এলোমেলো অস্থির লক্ষ্মী কখন হয়ে যায় অলক্ষ্মী, আবারও লক্ষ্মী হওয়ার চেষ্টা …
লক্ষ্মীদি বলতে সারা বছর পঙ্গু বাবা মার সেবিকা,লক্ষ্মী মাসি নিজের পর্ণ কুটির ফেলে আমার সংসার সাজিয়ে রাখে, লক্ষ্মী মানে যে সারাদিন আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সারাদিন শিক্ষক শিক্ষিকার সমস্ত আবদার পালন করে।
কখন যেন বাবুর বাড়ি কাজ করতে গিয়ে লায়লি হয়ে যায় শাঁখা সিঁদুর পরে লক্ষ্মী ,এনে দেয় দিদার পুজোর ফুল।
আমরা কেউ কেউ লক্ষ্মী নয়। এলোমেলো বিশ্রস্ত, তবু চাঁদের দিকে চেয়ে কামনা করি “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”।
এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে লক্ষ্মী রূপেই চায়। কর্তব্যের শৃঙ্খলে বাঁধা,আত্ম ত্যাগের প্রতীক।
নারী, শক্তি, ফলদায়িনী, সুগৃহিণী মনহীন কামনার ঘট হয়ে পুরুষের আধারমাত্র।