তিন নম্বর ঘরের স্টীলের আলমারিটা গোছাতে ব্যস্ত অপর্ণা। তিন নম্বর নামের মূল কারণই হল অনেকটা ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত। না সেটা শোবার ঘর, না সেটা বসার ঘর বা ঠাকুর ঘর। অথচ লম্বা চওড়ায় সে বেডরুমের চেয়ে বেশ বড়। একটু ভৌতিক বা আচ্ছন্ন ভাব থাকার জন্য সেটাকে ত্যাগ করে এখন স্টোর রুমের মতই ব্যবহার করা হয়। যাই হোক, সারাদিনই ঘর পরিষ্কার করছে অপর্ণা আর সুযোগ পেলেই রোজ একবার করে আলমারিটা খুলে গুছিয়ে নিচ্ছে। না, না, টাকাপয়সা বা জামাকাপড় নিয়ে সে রোজ নাড়াচাড়া করে না। সে গুছিয়ে রাখে সংসারের সব নথিপত্র। মেয়ের স্কুল-কলেজের সব ডকুউমেন্টস, অভিমন্যুর ডাক্তারি রিপোর্ট, প্রেসক্রিপসন, দলিল, রসিদ, ব্যাঙ্কের নথি, চাকরি-জীবনের কাগজপত্র, প্যান-ভোটার-আধার সবকিছু। তাছাড়া আলমারির মধ্যেও আবার প্যাকেটে প্যাকেটে বন্দী করে রাখে জামা কাপড়ের সব আইটেম। যেমন কোনো প্যাকেটে শার্ট, কোনো প্যাকেটে টপ, কোনোটায় শাড়ি, কূর্তি, ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে মনে হয় অপর্ণা যদি কোনও অফিসের ডকুমেন্টস কন্ট্রোল বিভাগে চাকরি করত তাহলে বিরাট নাম কামাতে পারত, আজ সে যেটা সংসারের হেঁসেল ঠেলে সব জলাঞ্জলি দিয়ে দিল। যাই হোক, এটাতো গেল তার একদিকের কর্মযুদ্ধ। আসল কর্মযুদ্ধ শুরু হয় ভোর পাঁচটায়। যার প্রথম পর্যায় হ’লো শীত-গ্রীস্ম-বর্ষাকে অবজ্ঞা করে ভোরে উঠে স্নান করে পুজো করা। আর কোনো অনুষ্ঠানের আগে সবকিছু পরিষ্কার করা হয় তো, সেই জন্যই এসব নিয়ে অপর্ণা আজ খুব ব্যস্ত। ঘর দোর পুরো পরিষ্কার করা, রান্না বান্না, সংসারের এত কাজ, সব কিছু সামলে আবার করোনার আবহে অগ্রিম অবসর নেওয়া স্বামীকে সামলানো, সে কি কম ঝক্কি। এদিকে করোনার কারণে কাজের মাসীকে টাটা-বাইবাই করা হয়েছে প্রায় ন-মাস হ’লো। অভিমন্যু, যার স্ত্রীকে ছাড়া আজ বিয়ের এত বছর পরও এক মুহূর্তও চলে না।
মিষ্টি এক মেয়ে নিয়ে অভিমন্যু আর অপর্ণার সংসার শ্যামবাজারে। ছোট নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হলেও অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। কারণ ওদের মধ্যেকার স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা আর পাঁচটা বয়স্ক স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের থেকে অনেক আলাদা। বিয়ের পর থেকেই বাপের বাড়ি যাওয়া অনেকটা কমে গেছিল অপর্ণার, নিজেই নাকি বেশি যেতে চাইত না, এবং সবাই সে নিয়ে হাসাহাসিও করত খুব, বরকে ছেড়ে নাকি থাকতে পারে না, তাই বাপের বাড়ির কথা মনেই পড়ে না। উল্টোদিকটাও সত্যি, বিয়ের পর থেকে অভিমন্যুও স্ত্রীকে ছেড়ে ক’দিন থেকেছে হাতে গুনে বলা যাবে।
অপর্ণা যখন প্রথম এ বাড়ির বউ হয়ে এল, বয়স মাত্র ১৮, অভিমন্যুর তখন ২৮, তখনকার দিনে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এতটা বয়সের ফারাক খুব স্বাভাবিক ছিল। একতলা বাড়ির লম্বা দালান পেরিয়ে আলতা পরা ছোট্ট মেয়েটা একমাথা সিঁদুর নিয়ে যখন স্বামীর সাথে প্রথম এ বাড়িতে প্রবেশ করেছিল, তখন সে নেহাতই নাবালিকা, ভীত, সন্ত্রস্ত, আগামী নতুন জীবন নিয়ে। শাশুড়িমা সেদিন সন্তানের মতোই আপন করে নিয়েছিলেন।
আলমারিটা গোছাতে গোছাতেই একটা মোটা খামের উপর হাত পড়ল অপর্ণার। সেই চিঠিগুলো, যেগুলো আজ এত বছর ধরে অপর্ণা সযত্নে লুকিয়ে এসেছে সবার চোখের থেকে। খামটা খুলতেই পুরোনো কাগজের গন্ধটা নাকে এল, একটা চিঠি বের করল, অনেকগুলো চিঠির মধ্যে থেকে। পরম যত্নে লুকানো তার পাঠানো প্রেমপত্র, যার হদিশ জানে না কেউ। এত সুন্দর হাতের লেখা, এত সুন্দর বলার ধরনেই প্রেমে পড়ে গেছিল তখন অষ্টাদশী কন্যা। যার লেখা এত সুন্দর, যার শব্দ মনে ঝড় তোলে, কত সুন্দর মানুষ হবে সে, নিজের অজান্তেই তাঁর প্রেমে পড়েছিল ষোড়শী অপর্ণা। তখনকার সময়ে বাড়ির সবার চোখ রাঙানির আড়ালে ঐ বেনামী প্রেমিকের প্রেমের কাছে নতি স্বীকারের স্বীকারোক্তি স্বরূপ এক দুটি চিঠি শোভাও ফেলেছিল বইকি। প্রেমিক কখনোই প্রেমপত্রে নিজের নাম লেখেনি, নিজের শব্দ আর ভাষা দিয়েই ছোট্ট অপর্ণার মনে গেড়ে বসেছিল পাকাপাকি ভাবে।|
অপর্ণার এখনও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, দিদি জামাইবাবু অনেক বুঝিয়েও সেদিন বাবাকে রাজি করাতে পারেনি। সারারাত মনের ভিতর যুদ্ধ চলেছিল সেদিন, কাঁদা ছাড়া আর যে কোন উপায় ছিল না। কে শুনবে তখন মেয়েমানুষের প্রেমের কথা? ও যে ঘোর পাপ। কাউকে কিচ্ছু বলতে পারেনি সেদিনের ছোট্ট মেয়েটা। শেষে বাবা যেদিন পাকা কথা বলতে গেল কাকাদের সঙ্গে নিয়ে সেদিন মনের ভিতর কৈশোরের প্রথম প্রেম আরও একবার প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছিল সেদিন।
তারপর চিঠির বেনামী প্রেমিক যেদিন প্রথম সামনে এল, বিয়ের আসরে, সেদিনকার থেকে বেশি আনন্দ মনে হয় সারা জীবনে কোনোদিন পাননি উনি। সেদিন দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে বাবাকেও আর একবার প্রণাম করে নিল অপর্ণা। অপর্ণা আর অভিমন্যু-র অজানা-অচেনা, ভিন্ন এই প্রেম কাহিনী ঘরের দিদি-জামাইবাবু ছাড়া পরিবারের কেউ জানত না, কেউ না, আর জানে চিরনতুন এই দুটি মানুষ, যারা হাসতে হাসতে নিজেদের জীবন একে অপরের নামে করে দিয়েছেন, আর আজও সেই বন্ধন অটুট|
অভিমন্যু আজ হয়ত আর চিঠি লেখে না তবে আজও কবিতা আর গল্প লেখার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। তার সব কবিতায়, গল্পে অপর্ণার প্রতি অকুন্ঠ ভালবাসা টের পাওয়া যায়। কিন্তু ঘর গোছাতে গোছাতে স্ত্রী-এর সযত্নে লুকিয়ে রাখা পুরোনো প্রেমের চিঠিগুলো নিয়ে বসে থাকাটা তার নজর এড়ায়নি। স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে সেইসব দিনগুলো।
অভিমন্যু একটুও লজ্জা না পেয়ে অপর্ণার কানের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘তোমার কি মনে পড়ে আবৃত্তির ক্লাসে ঢোকার পরেই যেদিন দুজন মুখোমুখি হয়েছিলাম, বড্ড সাদামাটা ছিল সে দেখা, বড্ড সাদামাটা সে পরিচয়’। আসলে অভিমন্যু কলেজে ঢোকার পর আলাপ হয় অপর্ণার সঙ্গে। সে সময় তার জয়েন্টের প্রস্তুতিও চলছিল। আর অপর্ণা তখন সবে ক্লাস নাইন থেকে ক্লাস টেন-এ উঠেছে। প্রথম দিন তার সাথে দেখা হওয়ার ঠিক পরের দিনই অপর্ণা একটি দু-লাইনের চিঠি লিখে অভিমন্যুর বন্ধু সুমনকে দিয়ে বলল এইটা একটু অভিমন্যুদাকে পৌঁছে দেবেন প্লিজ। অভিমন্যু চিঠিটা পাওয়ার পর এক অজানা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কোনও মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া তার জীবনের প্রথম চিঠি। আসলে সে কোনওদিন ভাবতেই পারে নি তাকে কোনও মেয়ে চিঠি লিখতে পারে। চিঠিটা খুলে পড়ার আগেই তার হাত কাঁপতে থাকে। কপাল ঘামতে থাকে। চিঠিটা খুলে দেখে বয়ানও খুব সংক্ষিপ্ত। একে ঠিক প্রেমপত্র বলা যায় না। লেখা আছে, “আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভালোই লাগল। আমি ভোরবেলা ট্রাঙ্গুলার পার্কে থাকব। ওখানে সাইকেল চালানো প্রাকটিস করি। আপনি আসলে ভালোই হবে। কথা হবে”। অভিমন্যু ভাবতে থাকে যাবে কি যাবে না? বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে। বন্ধুরা বলে, আরে গুরু এমন অফার কেউ হাতছাড়া করে। কেউ বলে আমি হলে তোদের জানাতামই না। সোজা গিয়ে হাজির হতাম। আসলে বন্ধুরা তো মজা করতে আর চড়িয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। একটা স্থির আলোচনায় বসে, যাওয়া উচিত কি না সে ব্যাপারে আলোকপাত করার ধৈর্য্য কোথায় তাদের? অভিমন্যু এ কথাও ভাবছে ওই ভোরবেলা মা-কেই বা কি বলে বেরোবে? শেষে মা-কে মিথ্যা বলেই বেরোতে হল যে ওয়ান ডে ক্রিকেট টুর্নামেন্টের প্রাকটিস আছে। অভিমন্যু দেখা করল, অনেক কথাই হলো। বেশী কথাই হলো কে কি পড়ছে সেই বিষয় নিয়ে। নামধাম ও জানা হলো, পরিবারে কে কে আছে সেই বিষয় নিয়েও আলোচনা হল। সুপর্ণা হঠাৎই বলে উঠল “আমি স্কুল থেকে সাড়ে চারটের সময় ফিরি আপনার পাড়ার রাস্তা দিয়েই। যদি থাকেন তো ভালো হয়। কথা কিছু হবে না, কারণ বন্ধুরা থাকে। ওই একটু দূর থেকে দেখা হবে। এটাই বা কম কি বলুন”। এভাবেই ধীরে ধীরে প্রেমের সূচনা। তারপর অভিমন্যু ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পড়াশুনা নিয়ে। জয়েন্ট এন্ট্রান্স দেয়। মাঝে মাঝে দেখা হয়, কখনও আবার হয় না। যখন একবার একটু দেখার জন্য মনটা ছটপট করে তখন ওই পাড়ার মোড়ে এসে সাড়-চারটের সময় দাঁড়িয়ে থাকে। একটিবার দেখার জন্য।
যাই হোক অভিমন্যু জয়েন্টে দুর্গাপুর আর-ই কলেজে চান্স পায়। মাসে একবার আসে মা-র সাথে দেখা করবার জন্য। ওই সময়ে অপর্ণার সাথেও দেখা করে। আর অপর্ণা সারা মাস ধরে অভিমন্যুর উদ্দেশে যে চিঠিগুলি লেখে যেগুলি সে ভয়ে বা লজ্জায় পোষ্ট করতে পারে না, সেগুলি অভিমন্যু এলেই সুন্দর গিফ্ট-প্যাক করে উপহার দেয়। সে চিঠিতে ভরা থাকে উক্তিতে, কখনও রবিঠাকুরের, কখনও নজরুলের ইত্যাদি আরও অনেক। অভিমন্যু ও কম যায় না, কখনো নামী কবিদের উক্তিতে কিংবা নিজেই কবিতা লিখে প্রত্যুত্তর দেয়। যেমন ভাবে অপর্ণা লিখত, “ভালবাসা আমাকে স্বার্থপর করেছে৷ তোমাকে ছাড়া আমার অস্তিত্ব নেই৷ আমি প্রায় সবকিছুই ভুলে যাই, কিন্তু তোমাকে আবার দেখার কথা ভুলতে পারি না”-
“ত্বমসি মম জীবনং, ত্বমসি মম ভূষণং,
ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম্।”
কখনও প্রত্যুত্তরে অভিমন্যু লিখে পাঠাত, “ভালোবাসার যদি কোনও অ্যাকাউন্ট থেকে থাকে, তবে তোমার কাছে ঋণে আমি যারপরনাই খুশি৷ তোমার সঙ্গে আর তোমার হদয়ে বেঁচে থাকার এ অনুভূতি, আমি কোন ভাষায় বা প্রকাশ করব” – আবার রবিঠাকুরের কবিতাও উল্লেখ করে নিবেদন করত
“সুন্দরী তুমি শুকতারা
সুদূর শৈলশিখরান্তে,
শর্বরী যবে হবে সারা
দর্শন দিয়ো দিক্ভ্রান্তে”।…
কখনও নিজেই লিখে দিত সুপর্ণাকে
“ফুলের প্রয়োজন নেই। মন শুধু চায়
সাহসের। যা তোমাকে দেয় প্ররোচনা
আজ প্রেমের ক্ষুধা চাই এই অবেলায়
জীবন তো শিখিয়েছে শুধু যন্ত্রণা”।…
যাই হোক একদিকে রোমান্স আর অন্যদিকে কলেজের রেগিং এর পর্ব শেষ করে এবার সেমিস্টার এর পর্ব। বারবার অভিমন্যুর মনে হয় বাবার স্বপ্ন সফল করতে হবে। অন্যদিকে বিধবা মা অধীর আগ্রহে ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সেমিস্টারের আগে অভিমন্যু সারা রাত জেগে পড়াশুনা করে। এক-এক করে ছ-টা সেমিস্টার শেষ হয়ে যাওয়ার পর অভিমন্যু ভাল রেজাল্ট করে প্রথম দশ জনের মধ্যে নিজের নাম ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ের জন্য পাকা করে রাখে। বন্ধু সুভাশিষও অবশ্য প্রথম দশ জনের মধ্যে আছে। এক-এক করে আই-টি কোম্পানিরা আসে। সুভাশিষ প্রথম শটেই এক নামকরা আই-টি কোম্পানিতে লাগিয়ে দেয়। যদিও ও সিভিল-এর স্টুডেন্ট। অভিমন্যু আই-টি তে অত ইন্টারেষ্টেড নয়। কিন্তু অভিমন্যুর এমনই দুর্ভাগ্য কোর কোম্পানিরা আর আসে না। তারপর একসময় ফাসট্রেটেড হয়ে পড়ে। শেষে সেভেন সেমিষ্টারের আগে এক মাল্টিন্যাশনাল কন্সট্রাক্সন কোম্পানি এসে পড়ে। বাবা-মা’র কথা স্মরণ করে সারারাত জেগে পড়াশুনা করে। মা’র আশীর্বাদে সব পরীক্ষায় পাশ করে অবশেষে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পায়। অষ্টম সেমিস্টারের শেষে সে আরও ভালো রেজাল্ট করে সে সেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
চাকরিতে জয়েন করার আগে অভিমন্যু মা-র সঙ্গে দেখা করার জন্য বাড়ি আসে। যে মা স্বামীকে হারানোর পর ছেলের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতে পারেন নি, আজ ছেলেকে জড়িয়ে ধরে তার চোখ দিয়ে আনন্দধারা বয়ে যায়। ছেলের চোখও ঝাপসা হয়ে ওঠে। যে আত্মীয়স্বজন আর পাড়াপ্রতিবেশীরা এতদিন নীচু নজরে দেখত আজ তারা বাড়িতে এসে অভিনন্দন জানাচ্ছে, কেউ ফোনে উইশ করছে, হোয়াটসঅ্যাপে কনগ্রাচুলেট করছে। প্রতিবেশী মহিলারা ইন্দ্রানীদেবীকে জড়িয়ে ধরে বলছে, এতদিন ক্ষুদ খেয়ে, কখনও না খেয়ে, সারারাত সেলাই করে, বাপের বাড়ীর গঞ্জনা সয়ে, সংসার জীবনে লড়াই করে এবার ইন্দ্রানীদি সুখের মুখ দেখবে। হায়, সুখের দর্শন পাওয়া কি অতই সোজা।
এইভাবেই অভিমন্যু একদিন বাধ্য হয়ে সবকিছুকে দূরে ঠেলে চাকরি নিয়ে চলে গেল হায়দ্রাবাদ। ডিউটি আওয়ার্সের কোনও ঠিক নেই। সকাল সাতটায় মেস থেকে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে বের হত, রাত দশটা সাড়ে দশটা বেজে যেত আবার মেসে ফিরে আসতে। কোনও দিন হয়ত আরও দূর যেতে হত। তখন হয়ত আর সেই মেসে ফেরা হত না। কাজের লোকেশনের কাছাকাছি কোনও হোটেল ভাড়া নিয়ে থাকত। না, না সেটা কোনও বড় হোটেল নয়। স্টার মার্কিং (ওয়ান টু সেভেন স্টার) তো দূর অস্ত। সুলভ কমপ্লেক্স এর মত টয়লেট, আর রুম ভাড়া জন প্রতি দুশো থেকে তিনশ টাকা। আসলে ওদের প্রজেক্ট ছিল ট্রান্সমিশন লাইনের কাজ। ওই যে ট্রেনে যেতে যেতে আমরা দেখতে পাই টাওয়ার এগিয়ে চলছে ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে, কখনও সাতরে পার হয়েছে নদীর ওপারে, কখনও ট্রেকিং করে উঠে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ের চূড়ায়। ওদের কাজ ছিল চারশ কেভি লাইভ (জীবন্ত) লাইনে আর্থ কন্ডাকারকে কেটে বাদ দিয়ে অপটিক্যাল গ্রাউন্ড ওয়্যার লাগানো। কি ভাবছেন, চারশ কেভি লাইভ লাইনে কি ভাবে কাজ হয়। কারেন্ট খেলে তো ছাই হয়ে যাবে। হাড়-মাংস কিছুই তো থাকবে না। সত্যিই তাই। কারেন্ট খাওয়া অর্থাৎ ডাইরেক্ট কেবিলের সঙ্গে কনটাক্টে আসার কথা ছেড়ে দিন। তার ইন্ডাকশন কারেন্টের যা তেজ তাতেই আপনি জ্বলে যাবেন। আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন বর্ষার সময় আপনার শহরের লোকাল ট্রেনের স্টেশনে ভিজে ছাতা হাতে দাঁড়ালে কিরকম অনুভূতি হয়। আর লাইন বন্ধ করে কাজ করা? সেটা ভুলে যান। তাহলে ট্রেন, কারখানা, বাড়ীর লাইট পাখা কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাবে। সকালে যে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে বেড়িয়েছিল, তার মধ্যেই একসঙ্গে জড়িয়ে জাপ্টে ছিল ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ। ইংরাজী ওয়ার্ডগুলো শুনলে যেমন পেট ভরে যায় আসলে মাঝেমাঝেই ওদের দুজনকে বেলা তিনটের সময় ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ একসঙ্গে খেতে হত। ডাইনিং টেবিলে বসে কিংবা পুরোনো প্রথার মত আসন করে খাওয়ার কথাও ভুলে যান, গাছের তলায় টিফিন ক্যারিয়ার খুলে, জলের বোতল নিয়ে বসত ও। বন্ধু-স্টাফ বলতে যাই বুঝুন, একটা কুকুর পাশে বসে তাকিয়ে দেখত ওর খাওয়া। সেও শেয়ার কিছুটা কুকুরকে। দু-দিনেই বন্ধু হয়ে গেল কুকুরটা। তবে একটা দিক দিয়ে খুব বড়লোক ছিল।অভিমন্যুর সঙ্গে সবসময় থাকত একটা জীপ। মেস বা হোটেল থেকে আনা দু-তিন বোতল জল আর ট্যুরিষ্ট ব্যাগটা ওই জিপটার মধ্যে রেখে কাজের লোকেশন থেকে দূরে পার্ক করিয়ে রাখত। লেবার কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে জল আশেপাশে না পেলে ওই জীপের মধ্যে রাখা জল সব শেষ করে ফেলত। গলা শুকিয়ে কাঠ হলেও কিছুই করার নেই। আশেপাশের খাওয়া যেতে পারত কিন্তু অভিমন্যু বড্ড ভয় পায় যদি এই চাঁদি ফাটা গরমে যদি আবার পেটের ট্রাবলস দেখা দেয়। আবার মিনারেল ওয়াটার কিনতে গেলে গাড়ী নিয়ে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে শহরে যেতে হবে। যাই হোক, এই চাকরি করার পর আর এই ট্রান্সফারের ছন্নছাড়া জীবনের কথা ভেবে অভিমন্যুর মনে হয়েছিল এ জীবনে আর বিয়ে করবে না। অফিসের বস থেকে শুরু করে সবাই অভিমন্যুকে চাপ দিতে থাকে বিয়ে করার জন্য। তাদের একটাই প্রশ্ন, ম্যাডামকে কবে দেখতে পাব? অভিমন্যু যতই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে অফিস কলিগরা ততই চেপে ধরে। কেউ কেউ তার আত্মীয়ার সাথে বিয়ে দিতে চায়। আবার কেউ তো আত্মীয়াদের ফটো নিয়েও হাজির হয়। শেষে একদিন বাধ্য হয়ে মিথ্যা কথা বলতে হয় যে আমার মা একটা পাত্রী দেখে রেখেছেন তার সঙ্গেই বিয়ে হবার চান্স আছে। একথা বসের কানে যাবার পরই বস্ মা-র ফোন নম্বর চেয়ে মা-র সঙ্গে কথা বলবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। “স্যার আমি দেখছি মা-র সাথে কথা বলে”। এই কথা বলে কোনোমতে বসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেল। আসলে যেদিন অভিমন্যু ট্রাঙ্গুলার পার্কে সুপর্ণার সঙ্গে ওর স্কুটির প্রাকটিসের উপলক্ষে দেখা করতে গেল সেদিন থেকেই প্রেম পর্যায়ের এক টেনশনের জীবনে বাঁধা পড়ে গেছে। অনেকদিন এমন হয়েছে বিয়ে করবে না বলে অভিমন্যু সুপর্ণাকে অ্যভয়েড করেছে। সুপর্ণা বারবার দেখা করতে এলেও অভিমন্যু পালিয়ে গেছে। শেষে সুপর্ণা ওর দিদিকে পাঠিয়েছে অভিমন্যুর বাড়িতে। সেখানেও অভিমন্যু ধরা দেয় নি। মা-কে দিয়ে মিথ্যা বলিয়ে পাঠিয়েছে যে অভিমন্যু বাড়িতে নেই। তার জন্য অভিমন্যুকে মা-র কাছে অনেক জবাবদিহি করতে হয়েছে। মেয়েটি কে? কি জন্য তোকে খুঁজছে? এ মেয়ে তো তোর চেয়ে অনেক বড়। কিছু অঘটন ঘটাস নি তো এই মেয়েটার সঙ্গে? আসল কথা হল এই অপর্ণার দিদির সঙ্গেই অভিমন্যুর আগে পরিচয়। এই ঘটনা বলতে গেলে একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। কলেজ লাইফের একটা সময় অভিমন্যু পাড়ায়, বেপাড়ায় কবিতা আবৃত্তি করে বেড়াত। অনেক প্রাইজও পেয়েছে। তা একদিন পাড়ারই একটা প্রাইমারি স্কুলে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ছিল। অভিমন্যুর স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র সঞ্জয় একসময় ভাল আবৃত্তি করত। তার একটা আবৃত্তির স্কুল ছিল। সেই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা সেদিন ওখানে উপস্থিত ছিল সঙ্গে তাদের গার্জিয়ান। সেই ছাত্র-ছাত্রীদের দলে ছিল সুপর্ণা। আর তার দিদি ছিল গার্জিয়ান হিসাবে। সেদিন অপর্ণা বা তার দিদি কাউকেই অভিমন্যু চিনত না। তবে অপর্ণার দিদিকে পাড়ার রাস্তায় অনেকবার যেতে আসতে দেখেছে। সেই দেখা থেকেই অভিমন্যুর যতটুকুই বা মুখ চেনা, এর বেশি কিছু নয়। যাই হোক অভিমন্যুর কন্ঠে রবিঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি শোনার পর তার দিদি অর্থাৎ সুপর্ণাদি যেচে পড়েই অভিমন্যুর সঙ্গে ভাব জমাতে শুরু করল। অভিমন্যুর খুব প্রশংসা করতে শুরু করল। বলতে লাগল, “অপূর্ব হয়েছে অভিমন্যু, অনেকদিন পর একটা ভালো কবিতা আবৃত্তি শুনলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি”। তার পরেই আবার জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কার কাছে আবৃত্তি শেখ, অভিমন্যু”? অভিমন্যুর সংক্ষিপ্ত উত্তর, “আমার মা আমাকে শেখান”। তারপরে যা হয় নিজের বোন অপর্ণাকে বগলদাবা করে নিয়ে এসে বলে, “এই আমার বোন, অপর্ণা। ও সঞ্জয়ের কাছে আবৃত্তি শেখে”। আর চিরচরিত প্রথায় কোনও অনুষ্টানের শেষে যে মিষ্টি-নিমকির প্যাকেট দেয়, সেই প্যাকেট থেকে অভিমন্যুকে জোর করে একটা মিষ্টি খাইয়ে দিল। অভিমন্যু যতই বলছে তার কাছে মিষ্টির প্যাকেট আছে, সে কি তখন কথা শোনার পাত্রী। এমন সময়ে আবার সঞ্জয়দা আবার অভিমন্যুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে গেল তোমাকে আমার দরকার হবে, সময়মত জানাবো। এভাবে কিছুদিন কাটার পর একদিন যখন অভিমন্যু পাড়ার ক্লাবে বসে তাস খেলছে তখন সঞ্জয় হঠাৎ হাজির। অভিমন্যুকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, “নজরুল মঞ্চে আমার স্কুলের একটা কবিতার অনুষ্টান আছে। অনেক নামীদামী শিল্পীরা আসবেন। একটা আলেখ্য তৈরি করেছি, তোমার কণ্ঠস্বর চাই। যাইহোক আমার স্কুলে একদিন চলে এসো। বাকি সব ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে তুমিও একটু রিহার্সাল দেবে”। সঞ্জয়দার সেই ভালোবাসার ডাককে অভিমন্যু ফেলতে পারেনি। পরেরদিনটা ছিল রবিবার। অভিমন্যু হাজির হল সঞ্জয়দার আবৃত্তির স্কুলে। অভিমন্যু সেখানে গিয়ে দেখতে পায় মহারানী সুপর্ণা ধ্যানমগ্ন হয়ে সঞ্জয়দার ক্লাস নিচ্ছে। অভিমন্যু যাওয়ার পরেই সবাই একটু নড়েচড়ে বসল। সঞ্জয়দা আলেখ্য সম্বন্ধে অভিমন্যুকে স্ক্রিপটা একটু বুঝিয়ে দিল। এরপর সব ছাত্রছাত্রী (অপর্ণা ছাড়া) ও সঞ্জয়দা অনুরোধ করল অভিমন্যুকে একটা আবৃত্তি করে শোনাতে। অভিমন্যু শোনাল রবিঠাকুরের ‘বাঁশি’। …… ‘যে আছে অপেক্ষা করে, তার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর’। কিছুক্ষণের জন্য পুরো ক্লাসটা হয়ে গেছিল পিন-ড্রপ-সাইলেন্ট। অপর্ণাও একটু নম্র দৃষ্টিতে অভিমন্যুর মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু ভাবটা তার এমন যেন তোমাকে আমি পাত্তা দিচ্ছি না। যাইহোক তারপর তো সব ইতিহাস। এই অপর্ণাই একদিন চিঠি লিখে প্রেমের আমন্ত্রণ জানায় অভিমন্যুকে। আসলে অপর্ণার দিদি সুপর্ণাদির ইন্সপিরেশনেই অপর্ণা এগিয়ে আসে অভিমন্যুর কাছে। অপর্ণার কানে অভিমন্যু সম্পর্কে যদি সবসময় গুনগান করা হয় তবে তো সুপর্ণার মনে যদি পঞ্চাশ ভাগ ইচ্ছা থাকে তবে তো দিদির সাপোর্টে আরও পঞ্চাশ ভাগ ইচ্ছা এমনিতেই জেগে উঠবে। হয়ত সুপর্ণাদিরই ইচ্ছা ছিল। বয়সের পার্থক্যে লোকলজ্জায় নিজে আসতে পারে নি তাই বোনের প্রেমের মধ্যে দিয়ে অভিমন্যুর প্রবেশকে অবাধে স্থান দিতে চেয়েছে। সেই জন্যই হয়ত অপর্ণার থেকে অভিমন্যু যতবারই পালানোর চেষ্টা করেছে ততবারই সুপর্ণাদি বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করে অভিমন্যুকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছে। একবার সুপর্ণাদি শিয়ালদায় একটা কাজ আছে বলে অভিমন্যুকে প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে গেছিল। শেষে কি না টেনে একটা অ্যাস্টোলজারের শো-রুমে। অভিমন্যুর জোর করে হাত দেখিয়ে বোনের কুষ্টির সাথে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিল এই প্রেম টিকবে কি না। অ্যাস্টোলজার অবশ্য না বলেছিল। হায়! অ্যাস্টোলজার আবার তুমি ভুল প্রমাণিত হলে। যাইহোক, ফিরে যাই সেই আগের ঘটনায়। সুপর্ণাদি অভিমন্যুকে বাড়িতে না পেলে কি হবে, অপর্ণা অনেক হিসেব-নিকেষ কষে খবরাখবর নিয়ে অভিমন্যুর বাড়িতে সাইকেল নিয়ে হাজির। দরজায় কড়া নাড়তেই অভিমন্যুর মা দরজা খুলেই অপর্ণাকে দেখেই যেন অসন্তুষ্ট। দেখা মাত্রই পরপর প্রশ্ন কে তুমি? কাকে চাই তোমার? অপর্ণা অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে উত্তর দিল আমি আসলে অভিদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমরা দুজনে একসঙ্গে আবৃত্তি করি। ওনার কাছে একটা বই আছে সেটা নিতে এসেছি। এমন সময়ে অভিমন্যু বারান্দায় এসে হাজির। মা-কে বলল ওকে তুমি চিনবে না মা। অপর্ণা আর আমি পয়লা বৈশাখে ক্লাবে আবৃত্তি করেছি। অভিমন্যু মা-কে কোনোমতে ম্যানেজ করে ঘরে পাঠিয়ে দিল। ওদিকে সুপর্ণা যাওয়ার সময় বলে গেল, “আমি কিন্তু আপনার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছি”। ইচ্ছা–অনিচ্ছা দূরে থাক, অভিমন্যু আত্মসম্মান রক্ষা করার জন্য স্টেশনে গিয়ে দেখা করল। আসলে দেখা করল বললে ভুল হবে, একরকম বাধ্য হয়েই ধরা দিল। এই যে ধরা দিল আর চিরজীবনের বন্ধনে আটকে গেল। তারপর শুরু হল প্রেমের পরিভ্রমণ। কখনও ভিক্টোরিয়া, কখনও ইডেন গার্ডেন, কখনও বেলুড় তো কখনও দক্ষিনেশ্বর। অভিমন্যু ক’দিনের ছুটিতে বাড়ি এলে পাড়া-বেপাড়ার কোনও অলিগলি বাদ থাকত না। এ জন্য পাড়ার লোকের কাছে অনেক সময়ে বদনামও শুনতে হয়েছে। সবসময় অভিমন্যুর যে এই ব্যাপারটায় সায় ছিল তা নয়। কিন্তু একটা অদৃশ্য ভয় সবসময় অভিমন্যুকে তাড়া করে বেড়াত যদি দেখা না করে তাহলে অপর্ণা যদি আবার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়। যাই হোক, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, প্রেম ঘনীভূত হয়ে একদম সম্পৃক্ত দ্রবণে পরিণত হয়েছে। মাঝে সুপর্ণাদি এক-একবার এসে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায় – ‘অভি, প্রেমের তো অনেক বয়স হয়ে গেল, এবার যে চারহাত এক করতে হবে’।
যাই হোক, মাঝে মাঝে মান অভিমান, ভুল বোঝাবোঝি, সব ভুলে এবার চার হাত এক হতে চলেছে। মাঝে নেই কোনও বাধা। অপর্ণা এবং অভিমন্যুর বিয়ের ব্যাপারে একের পর এক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অবশেষে বিয়ের সবটাই অবশ্য সম্ভব হয়েছে সুপর্ণাদির জন্যই। অজান্তেই বিয়ের সমস্ত কাজে সামিল ছিল সুপর্ণাদি। অপর্ণা হয়ত অভিমন্যুকে ভুল বুঝেছিল। অন্ধকারের মেঘ কাটিয়ে আনন্দের দিনে তারা পা রেখেছিল আজ থেকে ঠিক চব্বিশ বছর আগে।
আজই অনুষ্ঠান, অভিমন্যু আর অপর্ণার চব্বিশতম বিবাহ বার্ষিকী। এই দিনেই অষ্টাদশী রূপবতী, কেশবতী তার আলতা পরা ছোট ছোট পায়ে একমাথা সিঁদুর নিয়ে সেই পাগল প্রেমিকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সেই প্রেমিক, যে দীপেনবাবুর কনিষ্ঠা কন্যাকে আবৃত্তি ক্লাসে একবার দেখেই প্রেমে পড়েছিল। সেই প্রেম সময়ের সাথে এতটাই গভীর হয়, নিজের বাবা কাকাদের বলে অবশেষে সম্বন্ধ যায় মেয়ের বাড়ি | কিন্তু এই বেনামী চিঠির অদল বদল-এর সাথে মনের অদল বদল-এর কারসাজি আর কেউ কোনোদিন জানতে পারেনি।
সারাদিনের অনুষ্ঠান শেষ হলো। একমাত্র মেয়ে, মানে মেয়ে নন্দিতার থেকে ঠিক টুক করে ব্যাপারটা শিখে নিয়েছে অভিমন্যু। স্ত্রী শুতে যাবার জন্য বিছানা গোছাতেই হাতটা ধরল।
“কী হলো?” অপর্ণা অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
-“এটা নাও, শুনে দেখ একবার, এটা আজ আমার তরফ থেকে।”
-“ওমা, এ আবার কী, এইটুকু পুঁচকে। শাড়ি তো দিলে গো।”
-“দ্যাখোই না, এটাকে পেন ড্রাইভ বলে, কাল মেয়ে তোমাকে দেখিয়ে দেবে খন।”
মেয়ের ল্যাপটপে পরদিন অবশেষে চালানো হলো কয়েক মিনিটের ভিডিও ক্লিপিংসটা। অভিমন্যু আর অপর্ণার এত দিনের নানা মুহূর্তের ছবি কোলাজের মতো করে, সঙ্গে, সেই একই রকম, শব্দ ভাষার খেলা। বয়সের ভারে কিছুটা নুইয়ে পড়লেও মনটা এখনো প্রেমিক, যে নিজের প্রেমিকাকে বারে বারে প্রেম নিবেদন করেই যায়। কম্পিউটারে লিখে লিখে এখন এখন মাঝে মাঝে হাত কাঁপে, লেখা সম্ভব নয়, কিন্তু মনটা তো চির নতুন-ই, সবদিন, ভাষা শব্দগুলো তো আর হারায়নি।
লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল অপর্ণার মুখখানা। এই মুখটা দেখার জন্যই আমি সব করতে পারি, মনে মনে বলল পাগল প্রেমিক।