T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত
by
·
Published
· Updated
চিরনূতনেরে দিল ডাক – পঁচিশে বৈশাখ
২৫ বৈশাখ [১৩৪৮, বৃহ: 8 May, 1941]: রবীন্দ্রনাথ ৮০ বছর পূর্ণ করে ৮১ বছরে পদার্পন করলেন। রবীন্দ্রজীবনের শেষতম জন্মদিবস। শান্তিদেব ঘোষ লিখছেন, – “এই দিনটি যে কবির শেষতম জন্মদিন হয়ে এগিয়ে আসছে একথা হয়ত আমরা আগে থেকে কেউ অনুমান করতে পারিনি। এদিকে নববর্ষ আসছে দেখে কবির কাছ থেকে একটি গান চাওয়া হয়। প্রথমে আপত্তি করলেন, কিন্তু আমার আগ্রহ দেখে…বললেন ‘সৌম্য [ঠাকুর] আমাকে বলেছে মানবের জয়গান গেয়ে একটা কবিতা লিখতে । সে বলে আমি যন্ত্রের জয়গান গেয়েছি মানবের জয়গান করিনি। তাই একটা কবিতা রচনা করেছি, সেটাই হবে নববর্ষের গান ।’ কাছেই ছিলেন শ্রীযুক্তা মৈত্রেয়ী দেবী, তিনি গুরুদেবের খাতা খুলে কবিতাটি কপি করে আমাকে দিলেন। কবিতাটি ছিল একটু বড়ো, দেখে ভাবলাম এতো বড়ো কবিতায় সুরযোজনা করতে বলা মানে তাঁকে কষ্ট দেওয়া। সুর দেবার একটু চেষ্টা করে সেদিন আর পারলেন না, বললেন ‘কালকে হবে’। পরের দিন সেই কবিতাটি সংক্ষেপ করতে করতে শেষ পর্যন্ত, বর্তমানে ‘ঐ মহামানব আসে’ গানটি যে আকারে আছে,সেই আকারে তাকে পেলাম ।”
ওই মহামানব আসে ।
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে ।।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক–
এল মহাজন্মের লগ্ন।
এই মহামানব কি? এ তো কোনো ব্যক্তি যাঁহাকে আমরা মহাপুরুষ বলি তাঁহার আবাহন নহে। এই আবাহন কবির Man-কে – যে মানব আইডিয়ারূপে, শাশ্বত ঐক্যরূপে চিরন্তন, যে মানব ভাবীকালের অভ্যুদয়ের প্রতীক্ষায় রয়েছে। সেই দিক থেকে গানটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এই নববর্ষে [১ বৈশাখ ১৩৪৮] কবির ‘জন্মদিনে’ কাব্য প্রকাশিত হয়; এটাই তাঁর জীবিতকালের শেষ মুদ্রিত কাব্য।
যদিও বিগত বছরগুলির মত নববর্ষের [পয়লা বৈশাখ ১৩৪৮; ১৪ এপ্রিল ১৯৪১] দিনে ভোরবেলা প্রীতিপদ নববর্ষ উৎসব উৎযাপনের পর সন্ধ্যায় কবির ৮০ তম জন্মোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। উত্তরায়ণে রচিত একটি সুসজ্জিত মণ্ডপের নীচে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই উপলক্ষে রচিত একটি গান আশ্রমে বালিকারা সমস্বরে গাইলে কবিকে পুস্পমাল্য ভূষিত ও অন্যান্য মাঙ্গলিক আচার পালিত হয়। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন সুনির্বাচিত বেদমন্ত্রসমূহ উচ্চারণ করে কবিগুরুর প্রশস্তি করেন। এরপর আশ্রমবাসীদের শুভেচ্ছার প্রত্যুত্তরে তাঁদের উদ্দেশে কবি আশীর্বাণী দেন:
“আশ্রমবাসী কল্যাণীয়গণ, তোমরা আজ আমাকে অভিনন্দন উপহার বহন করে এনেছ। পরিবর্ত্তে আমার কাছ থেকে আশীর্ব্বাদ প্রার্থনা জানিয়েছ। প্রত্যহ নীরবে আমার আশীর্ব্বাদ তোমাদের প্রতি ধাবিত ও প্রবাহিত হয়েছে, দীর্ঘকাল নিরন্তর তোমাদের অভিষিক্ত করেছে। আমার আশীর্ব্বাদ আজ নূতন বেশে তোমাদের কাছে উপস্থিত হউক, সুন্দর বেশে তাকে তোমরা বরণ কর”। [গুরুদেবের ভাষণ ১লা বৈশাখে, ১৩৪৮ – শ্রীযুক্ত পুলিন বিহারী সেন মহাশয় লিখিত ১লা বৈশাখের অভিভাষণ ১লা বৈশাখের অভিভাষণ, ১৩৪৮]
২১শে এপ্রিল ১৯৪১ – রানী চন্দ লিখছেন – ‘নানা জায়গা থেকে ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী’ সংখ্যা বের হচ্ছে। সবই আসে গুরুদেবের কাছে এক-এক কপি করে। পাতা উল্টে যান, কখনো কিছু বলেন, কখনো বা চুপ করে থাকেন। এমনি একখানি কাগজ হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে গুরুদেব বললেন: “আমাকে এই স্তুতিবাদ চাটুক্তি করার মানে হয় না। এতে অত্যুক্তি থাকে অনেক। আর কি লাভ এই প্রশংসায়। …. সাহিত্যজীবনে খ্যাতি বড়ো ক্ষণস্থায়ী… দুদিনেই সব উবে যায়। সংসারের বড়ো জিনিস হচ্ছে প্রীতি, খ্যাতি নয়। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি যখন তোমাদের কাছ থেকে প্রীতি, ভালোবাসা পাই। …আমি এই ভালোবাসাই পেয়েছি জীবনে অনেক- কী দেশে কী বিদেশে। পেয়েছি নিজের লোকের কাছ থেকে, তার ঢের বেশি পেয়েছি অনাত্মীয়ের কাছ থেকে।” (আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ, রাণী চন্দ)।
কোনও আড়ম্বর বা চাকচিক্য নয়, শান্তিনিকেতনের নিভৃত পরিবেশে, একান্ত আপনজনেদের ভালোবাসার অর্ঘ্য পেয়ে সার্থক হল কবির অন্তিম জন্মদিন। সেদিন সন্ধ্যায় আশ্রমের ছাত্রীরা কবিকৃত ‘বশীকরণ’ প্রহসনটি অভিনয় করেছিল, কবি অভিনয়ের একেবারে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। এই তাঁর অন্তিম অভিনয়-দর্শন।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘রোগক্লান্ত জীবনের শেষ নববর্ষ এলো। এবার তাঁর নববর্ষের ভাষণ হল ‘সভ্যতার সংকট’। আজ ইউরোপ ও পৃথিবীর স্থানে স্থানে যুদ্ধের যে মরণতাণ্ডব চলছে, তারই কারণ বিশ্লেষণ করবার চেষ্ঠা করেছেন এই ভাষণে। ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুন দারিদ্র হৃদয় বিদারক। তার সঙ্গে যখন বহির্জগতের তুলনা করেন তখন মনের প্রশান্তি রক্ষা করা কঠিন হয়ে ওঠে। তাই কবি সেই দুঃখ নিয়ে বলছেন, –
“যে-যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজ আপনার বিশ্বকর্তৃত্ব রক্ষা করে এসেছে তার যথোচিত চর্চা থেকে এই নিঃসহায় দেশ বঞ্চিত, অথচ চক্ষের সামনে দেখলুম জাপান যন্ত্রচালনার যোগে দেখতে দেখতে সর্বতোভাবে কী রকম সম্পদবান হয়ে উঠল। সেই জাপানের সমৃদ্ধি আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি। দেখেছি সেখানে স্বজাতির মধ্যে তার সভ্য শাসনের রূপ আর দেখেছি রাশিয়ার মস্কো নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের আরোগ্যবিস্তারের কী অসামান্য অকৃপণ অধ্যবসায়। সেই অধ্যবসায়ের প্রভাবে এই বৃহৎ সাম্রাজ্যের মূর্খতা ও দৈন্য ও আত্মাবমাননা অপসারিত হয়ে যাচ্ছে। এই সভ্যতা জাতি বিচার করে নি, বিশুদ্ধ মানবসম্বন্ধের প্রভাব সর্বত্র বিস্তার করেছে। তার দ্রুত এবং আশ্চর্য পরিণতি দেখে একই কালে ঈর্ষা এবং আনন্দ অনুভব করেছি। মস্কাও শহরে গিয়ে রাশিয়ার শাসনকার্যের একটি অসাধারণতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছিল—দেখেছিলেম, সেখানকার মুসলমানদের সঙ্গে রাষ্ট্র-অধিকারের ভাগবাঁটোয়ার নিয়ে অমুসলমানদের কোনো বিরোধ ঘটে না, তাদের উভয়ের মিলিত স্বার্থসম্বন্ধের ভিতরে রয়েছে শাসনব্যবস্থার যথার্থ সত্য ভূমিকা”।
এই অভিভাষণের শেষে কবি যা বলেছিলেন তা ভবিষ্যৎবাণীর মত সফল হয়েছে –
“ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারতসাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন্ ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে, কী লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে? একাধিক শতাব্দীর শাসনধারা যখন শুষ্ক হয়ে যাবে তখন এ কী বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা দুৰ্বিষহ নিস্ফলতাকে বহন করতে থাকবে। জীবনের প্রথম-আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম যুরোপের সম্পদ অন্তরের এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি—পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ! কিন্তু, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মৰ্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবলপ্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারি প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে যে—
অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি ৷
ততঃ সপত্নান্ জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি”॥
যাই হোক, কবির জন্মদিন আসছে – মর্ত্যজীবনের শেষ জন্মদিনের জন্য লিখলেন [২৩ বৈশাখ ১৩৪৮] ‘হে নূতন দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’ এই গানটি। পূরবী-র “পঁচিশে বৈশাখ” কবিতাটির শেষ স্তবক পুনর্লিখন করে কবি এই গানটি লিখে দেন তাঁর শেষ জন্মোৎসবের জন্য। শান্তিদেব ঘোষ লিখছেন,
“১৩৪৮ সালের ২৫শে বৈশাখে গুরুদেবের জন্মোৎসব নিয়ে সমস্ত বাংলাদেশ যখন মেতে উঠল, … শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে গেছি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, পঁচিশে বৈশাখের দিন এখানে কি হবে। কথাবার্তায় বুঝলাম সেই জন্মদিন উপলক্ষ করে নৃত্যগীত ইত্যাদির আয়োজন হোক এই তাঁর ইচ্ছা। জন্মদিনের আগে একদিন সন্ধ্যায় প্রশ্ন করি, “উৎসবের সময় ‘আবার যদি ইচ্ছা কর’ গানটি কি গাইব। ” তাঁর জন্মদিনের গানের কথা তাঁকে জিজ্ঞাসা করাতে আপত্তি করে বললেন, ” তুই বেছে নে, আমার জন্মদিনের গান আমি বেছে দেব কেন।” একটু পরে উপরের গানটির প্রসঙ্গে অনেক কথা বলে গেলেন। কথার ভাবে বুঝেছিলাম যে, দেশ তাঁকে সম্পূর্ণ চিনল না এই অভিমান তখনো তাঁর মনে রয়েছে। বলেছিলেন, “আমি যখন চলে যাব তখন বুঝবে দেশের জন্য কি করেছি।” খানিকক্ষণ নীরব হয়ে থেকে ‘সার্থক জনম আমার’ গানটি প্রাণের আবেগে গেয়ে উঠলেন। বুঝলাম দেশ তাঁকে বুঝতে পারে নি এ অভিমান যতই থাকুক না কেন, দেশের প্রতি ভালোবাসা তাঁর কোনোদিন কমতে পারে না।
পরের দিন সকালে তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, “আপনি নিজের জন্মদিন উপলক্ষে কবিতা লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, অথচ একটা গান রচনা করলেন না, এটা ঠিক মনে হয় না। এবারের পঁচিশে বৈশাখে সমস্ত দেশ আপনার জন্মোৎসব করবে, এই দিনকে উপলক্ষ করে একটা গান রচনা না হলে জন্মদিনে অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয় না।”
শুনে বললেন, “তুই আবার এক অদ্ভুত ফরমাশ এনে হাজির করলি। আমি নিজের জন্মদিনের গান নিজে রচনা করব, লোকে আমাকে বলবে কি। দেশের লোক এত নির্বোধ নয়, ঠিক ধরে ফেলবে যে, আমি নিজেকে নিজেই প্রচার করছি। তুই চেষ্টা কর এখানে যাঁরা বড়ো বড়ো কবি আছেন, তাঁদের দিয়ে গান লেখাতে।” বলেই তাঁদের নাম বলতে শুরু করলেন। আমি হাসতে লাগলাম, তিনি বললেন, “কেন তাঁরা কি কবিতা লিখতে পারেন না মনে করিস?” উত্তরে বললাম, “আপনি থাকতে থাকতে অন্যদের কাছে চাইবার কি প্রয়োজন– যখন জন্মদিনের কবিতা লিখেছিলেন, তখন কি কেউ আপনাকে দোষী করেছিল?”
রাজী হয়ে জন্মদিনের কবিতাগুলি সব খুঁজে আনতে বললেন দপ্তর থেকে। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতাটির [পূরবী] ‘হে নূতন দেখা দিক আরবার’ অংশটি একটু অদলবদল করে সুর যোজনা করলেন। সেদিন ২৩শে বৈশাখ। পরের দিন সকালে পুনরায় গানটি আমার গলায় শুনে বললেন, “হাঁ, এবার হয়েছে। ”
সেদিন একথা ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি এই তাঁর জীবনের সর্বশেষ গান। [নিজের জন্মদিন উপলক্ষে রচিত প্রথম গান ১৩০৬ সালে, আটত্রিশ বছর বয়সে, “ভয় হতে তব অভয়মাঝে”] — শান্তিদেব ঘোষ, রবীন্দ্রসংগীত, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮.
‘পঁচিশে বৈশাখ’, ১৩৪৮ বৃহস্পতিবার [৮ মে ১৯৪১] কবি জীবনের শেষ জন্মদিন অনুষ্ঠান। শান্তিনিকেতনের আঙ্গিনায় অত্যন্ত অনাড়ম্বর বর্ণহীন অনুষ্ঠান। তবু পুরোটাই পবিত্রতায় ভরা। প্রভাতী, বৈতালিক সঙ্গীত, তারপর মন্দিরের উপাসনা আর সায়াহ্নে উত্তরায়ণে জন্মবাসরের অধিবেশনে নাচ গানের অনুষ্ঠান। সব শেষে ‘বশীকরণ’ নাটকের অনুষ্ঠান। যদিও পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কবি অপরাহ্নেই জানতে পেরেছিলেন তাঁর এই জন্মদিন অত্যন্ত প্রাণহীন হয়ে উঠবে। অবশ্য ক’দিন আগেই এই আশঙ্কার আভাষ পাওয়া যায় শ্রীমতি নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লেখা কবির চিঠিতে, –
“কল্যাণীয়েষু, এবার আমার জন্মদিন সুহৃদশুন্য জনশুন্য হবে। এমন রিক্ততা ইতিপূর্বে আর কোনোদিন হয়নি। সেই আশঙ্কায় স্বতঃ প্রবৃত্ত হয়ে তোমাদের আমন্ত্রণ করেছিলুম। তুমি খুব সংক্ষেপে লিখেছ জন্মদিনে যাব ‘ভাবছি’ – যদি দ্বিধা থাকে, তবে সেদিন আমার তপস্যার দিন আসবে, উপনিষদ হবে আমার সখা। তাঁর সঙ্গে আমার নিরাসক্ত সম্বন্ধ প্রত্যহ নিবিড় হয়ে আসছে”। – কবি [৩/৫/৪১]
এই শেষবারের জন্মদিন উপলক্ষে শান্তিনিকেতনের উদয়নে বসে ৬ মে [১৯৪১] সকালে একটা কবিতা লিখেছিলেন কবি। রচনার পর সেটি পাঠিয়ে দেন বাঁকুড়ায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের কাছে। একটি কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। সেই বছরের শ্রাবণ সংখ্যায় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপা হয়, পরে ‘শেষ লেখা’ কাব্যগ্রন্থে ১০ সংখ্যক কবিতারূপে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই কবিতায় কবি লেখেন:
“আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা,
আমি চাহি বন্ধুজন যারা
তাহাদের হাতের পরশে
মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে
নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ”।
মাত্র তিনমাস পরে যে চরম ক্ষণটি এগিয়ে আসছে সে সম্পর্কে কি অন্তর্দর্শন।
আমাদের জীবনে তাঁর প্রয়োজন এখনও যথেষ্ট। পৃথিবীতে যেখানে মানুষে মানুষে, স্বার্থে স্বার্থে লোভে লোভে সংগ্রাম চলছে, সেখানে তাঁর অমৃতবাণীর প্রয়োজন আছে, –
নব জীবনের সঙ্কট পথে
হে তুমি অগ্রগামী,
তোমার যাত্রা সীমা মানিবে না
কোথাও যাবে না থামি। …
যত আগে যাবে দ্বিধা সন্দেহ
ঘুচে যাবে পাছে পাছে,
পায়ে পায়ে তব ধ্বনিয়া উঠিবে
মহাবাণী, আছে আছে।
গ্রন্থ ঋণ: রবীন্দ্ররচনাবলী। রবীন্দ্র জীবনকথা – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবিজীবনী – প্রশান্তকুমার পাল।