।। ২২শে শ্রাবণে ।। ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

রবীন্দ্রনাথ ও শেলী – কল্পনা বিদ্রোহ ও বিষাদ
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
“তাহার পরে বয়সে আরো কিছু বড়ো হইয়াছি; সে-সময়কার লেখকদলের মধ্যে সকলের কনিষ্ঠ বলিয়া একটা আসন পাইয়াছি— কিন্তু সে-আসনটা কিরূপ ও কোন্খানে পড়িবে তাহা ঠিকমত স্থির হইতেছিল না; ক্রমে ক্রমে যে একটু খ্যাতি পাইতেছিলাম তাহার মধ্যে যথেষ্ট দ্বিধা ও অনেকটা পরিমাণে অবজ্ঞা জড়িত হইয়া ছিল; তখনকার দিনে আমাদের লেখকদের একটা করিয়া বিলাতি ডাকনাম ছিল, কেহ ছিলেন বাংলার বায়রন, কেহ এমার্সন, কেহ আর-কিছু; আমাকে তখন কেহ কেহ শেলি বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন”
রবীন্দ্রনাথ এবং শেলী এই দুই কবিকেই কল্পনার প্রথম প্রেমিক বলতে পারি। শেলী তাঁর একটি গদ্য কবিতায় বলেছিলেন যে মানুষ মূলত কল্পনাপ্রবণ “An Imaginative being”
ভাবলে অবাক লাগে প্রায় একই ভাবে একই সুরে কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ,
“যা বস্তুগত জিনিস তা মানুষের মনের স্পর্শে তারই মনের জিনিস হয়ে ওঠে। সেই মনের বিশ্বের সম্মিলনে মানুষের মনের দুঃখ জুড়িয়ে যায়, তখন সেই সাহিত্য থেকে সাহিত্য জাগে। যে-শক্তির দ্বারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের মিলনটা কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের মিলন না হয়ে মনের মিলন হয়ে ওঠে সে-শক্তি হচ্ছে কল্পনাশক্তি”
কল্পনাবিদ্ধ কবিজীবন কী রকম হতে পারে শেলী তার নমুনা দিয়েছেন “Prometheus Unbound” নামক কাব্যনাট্যে। কল্পনার অভিসারে সেই ভাসমান আত্মার অনন্ত বিস্তার পাচ্ছি এশিয়ার গীত-ঝংকারময় সংলাপ বাক্যে,
“My soul is an enchanted boat
Which like a sleeping swan, doth float”
আমার আত্মা এক বিমোহিত তরণী, রাজহংসের মত ভাসমান তোমার গানের রূপোর ঢেউয়ে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছত্রে ছত্রে কল্পনার প্রতি উচ্ছ্বসিত আসক্তির অবিকল এক প্রতিরূপ পাচ্ছি।
“অনন্ত এ আকাশের কোলে
টলমল মেঘের মাঝার
এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার”
ওয়ার্ডসওয়ার্থ অথবা শেলীর মতো রবীন্দ্রনাথও বিশ্বাস করতেন মধ্যবর্তিনী কল্পনার ভিতর দিয়েই সৌন্দর্য তথা বিশ্ব রহস্যের উন্মোচন সম্ভব।
“চিরপ্রশ্নের বেদীসম্মুখে চিরনির্বাক রহে
বিরাট নিরুত্তর,
তাহারি পরশ পায় যবে মন নম্রললাটে বহে
আপন শ্রেষ্ঠ বর”।
একেই বলতে পারি কবির দিব্যদর্শন। কল্পনা এই শব্দটি ‘কবি কাহিনী’-তে একাধিকবার খুব সচেতন ভাবে ব্যাবহৃত। কাব্যের প্রথম চরণেই কল্পনাবালা এই শব্দটি পাচ্ছি।
“শুন কলপনা বালা, ছিল কোন কবি
বিজন কুটীর-তলে। ছেলেবেলা হোতে
তোমার অমৃত-পানে আছিল মজিয়া”।
রবীন্দ্রনাথের যেমন ছিল ‘কবি কাহিনী’ তেমনই শেলীর আছে “Alastor”। কবিতাটির পঙক্তিতে কবি কল্পনার দিব্য আলোকে বসুন্ধরার আত্মপ্রকাশের বিবরণী আছে।
“Thou hast unveiled thy inmost sanctuary,
Enough from incommunicable dream”,
পার্সি বিসশেলী ১৭৯২সালের ৪ই আগষ্ট সাসেক্সের হরসেমে জন্মগ্রহণ করেন। শেলি ইটন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। অক্সফোর্ডে এসে শেলি প্রগতিবাদী লেখক যেমন, টম পেইন এবং উইলিয়াম গডউইনের লেখাসমূহ পড়া শুরু করেন। তিনি সাসেক্সের ব্যারণবংশীয়, যৌবনেই পিতৃদ্রোহী। তার সংক্ষিপ্ত জীবনে ( ১৭৯২ – ১৮২২) তিনি যেন বহু জীবনের কাজ করে গেছেন। শেষ লেখা “Triumph of Life” তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেন নি।
“Swift as a spirit hastening to his task
Of glory & of good, the Sun sprang forth”
পাশাপাশি বিপরীত বিন্যাসে স্থাপন করি রবীন্দ্রনাথকে – কল্পনার দেবদূত এই কবি কলকাতার অভিজাত জমিদার বংশের সন্তান। শিলাইদহ, শান্তিনিকেতন, ইয়োরোপ, আমেরিকা – বিভিন্ন ভুবন জুড়ে তিনি নিরন্তর ভ্রাম্যমান। রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে শিলাইদহ যাত্রা এক সন্ধিকাল বলে গণ্য হতে পারে।
“বেলায় উঠে দেখলুম চমৎকার রোদ্দুর উঠেছে এবং শরতের পরিপুর্ণ নদীর জল তল-তল থৈ-থৈ করছে”।… “দুপুরবেলা খুব এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তারপরে বিকেলে পদ্মার ধারে আমাদের নারকেল বনের মধ্যে সূর্যাস্ত হল। আমি নদীর ধারে উঠে আস্তে আস্তে বেড়াচ্ছিলুম”। এই পদ্মাপ্রেম রেশ রেখে গেছে চৈতালীর একটি কবিতায়,
“হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার”।
প্রমথনাথ বিশী তাঁর ‘রবীন্দ্রকাব্য প্রবাহ’ গ্রন্থে শেলী ও রবীন্দ্রনাথের তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন দুজন কবিই ধাবমান জলস্রোত খুব ভালোবাসতেন। শেলী নৌকা করে চলে যেতেন নদী থেকে সাগরে। আর রবীন্দ্রনাথ ভেসে যেতেন পদ্মার বুকে হাউসবোটে করে।
শেলীর কল্পনা নদীবুকে নৌকায় যাপিত জীবনকে যে পরম অর্ঘ্য দিয়েছিল তার প্রমাণ হিসাবে উপস্থিত করছি, “The boat on the serchio”
“OUR boat is asleep on Serchio’s stream,
Its sails are folded like thoughts in a dream”,