গল্পেরা জোনাকি তে ইন্দ্রাণী সমাদ্দার

এরকম ও হয়

দূরে কোথাও ফোন বাজছে। চোখের দুটো পাতায় ঘুম যেন আঠার মত আটকে আছে। দূরে ফোনের আওয়াজ বাজতে বাজতে থেমে গেলো। আবার শোনা যাচ্ছে ফোনের আওয়াজ। ওবাবাঃ এতো আমারই রিংটোন মনে হচ্ছে। তার মানে আমারই ফোন এসেছে। ঘুম একটু আলগা হয়েছে। ফোনে সময় সকাল আটটা জানান দিচ্ছে। নভেম্বর মাসের শেষের দিক। শহর কলকাতায় শীত – শীত ভাব। রাতে মেয়ের কাশি বেড়ে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত নিই, মেয়েকে স্কুল পাঠাবো না। তাই ঘুম আজ একটু দীর্ঘায়িত হয়েছে। ফোনের দিকে তাকিয়েই ঘুম উড়ে যায়। মায়ের ফোন থেকে পাঁচটা মিসড্ কল। আবার মায়ের দেখাশোনা যে মহিলা করে সেই অ্যাটেনডেন্ট দিদির ফোন নাম্বার থেকেও দুটি মিসড্ কল। কীযে হোলো।! মনে ভাবনা উঁকি মারতে মারতেই ফোনে ডায়েল করি ।মায়ের ফোনের অপরপ্রান্তে আয়াদিদি। কথা বলে ফোন রাখতে রাখতে নিশ্চিন্ত হই যে মা ঠিক আছেন। তবে কপালে চিন্তার ভাঁজ!

সকাল সকাল মায়ের বাড়িতে কে এলো ? মায়ের কোনো মামাতো ভাই নাকি এসেছেন । তা বেশ দিদির বাড়ি ভাই আসতেই পারে। তবে মায়ের ভাই যখন, তখন তার নিঃশ্চয়ই বয়স হয়েছে। তাহলে এতো সকাল সকাল কেন? কোনো জরুরি প্রয়োজন হবে নিশ্চয়ই । অগত্যা এখুনি গিয়ে একটু ব্যাপারটা দেখে আসতে হয় । মায়ের বাড়ি তার বাড়ির পাশেই। চায়ের কাঁপে গলা না ভিজিয়ে হাউসকোট গলিয়ে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে সে যখন মায়ের ফ্ল্যাটের দিকে রওনা হয় তখন তার রাজকন্যা ঘুমে কাদা।

মা ডিমেনসিয়ার পেশেন্ট। বাবা মারা যাবার পর থেকে একজন আয়া রাখা হয়েছে। সেই মহিলা মায়ের সঙ্গে থাকে। মুশকিল হচ্ছে মা খেয়ে বলে খায়নি আবার যে দিন বলে খাওয়া হয়ে গেছে , সেই দিন হয়ত আসলে খাওয়াই হয়নি । সেই মানুষ মামাতো ভাইকে কী চিনতে পারবে কে জানে! ভাবতে ভাবতে মুনিয়া মায়ের ফ্ল্যাটে কলিং বেল বাজায়। দরজা খুলে দেয় রমাদি। ঘরের ভিতরে আসতেই সে দেখে এক পঞ্চাশ কি মেরে কেটে বাহান্ন বছরের এক ভদ্রলোক সোফায় বসে। মা মুনিয়া কে দেখে বলে ওঠে –‘ দেখ দেখ তোর মামা এসেছে ।’ আমি মাকে বলি –‘ বলোতো কী নাম ? উনি কোথায় থাকেন ?’ মা বলে ওঠেন ‘উনি কীরে ?বল মামা’ , মাকে আবার নাম জানতে চাইলে মা বলেন ‘ওই তো কি যেনো নাম ? আরে বল না’ । ভদ্রলোক অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলেন ‘হ্যাঁ দিদি। আমার নাম ভুলে গেলে আমি পার্থ।’ এদিকে মা রমাদিকে বলেন- ‘তাড়াতাড়ি সাদা আলুছেচকি ও লুচি করে আনতো। ভাইটা আমার সারা রাত ট্রেন জার্নি করে এসেছে।’ রমাদি অর্থবহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আমি চোখের ইশারায় খাবার করতে যেতে বলি। মনটা খুত্ খুত্ করছে। মন বলছে ‘ডাল মে কালা হ্যায়।’ তবে ডালমে কুচ কালা, নাকি সবটাই কালো সেটা অবশ্য তদন্ত সাপেক্ষ ব্যাপার। কারণ মাকে সব ভাইবোন কুট্টিদিদি বলে। একথা সে মায়ের মুখ থেকে বহুবার শুনেছে। পার্থ বলে তার কোনো মামা আছে একথা সে কস্মিত কালে শোনেনি। যাইহোক মুনিয়াকে এই জট ছাড়াতেই হবে। সকাল থেকে গরম চা খাওয়া হয়নি বলে তার মাথা ঠিক খেলছে না। সে রমাদিকে চায়ের কথা বলে। পার্থ নামে তার এই সকালবেলায় আকাশ থেকে খোশে পরা মামার দিকে তাকায়। তারপর জিজ্ঞাস করে ‘কোথায় থাকা হয়’ ভদ্রলোক জানান তিনি রায়গঞ্জে থাকেন। অফিসের একটা কাজের উদ্যেশে তার কলকাতায় আগমন। আরো কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল কিন্তু মায়ের বকুনি শুনে থামে। মা বলে ওঠেন – ‘এতো কিছু জিজ্ঞাসা করার কী আছে’। মা যখন কথা এগোতে দিচ্ছে তখন মোবাইলে একে একে মাসতোত দাদাদের টেক্সট করে জানতে চায় তাঁদের আদৌ কোনো রায়গঞ্জ নিবাসী মামা আছে কিনা। এক ঝাঁক সুপ্রভাতের বার্তা এসে ইনবক্সে জমা হচ্ছে। মাসতোত দাদারা সুপ্রভাতের বার্তা পাঠিয়েছে কিন্তু যে প্রশ্ন করেছিল তার এখন পর্যন্ত কোনো উত্তর নেই। এদিকে আমার মনকে যত বলি মন শান্ত হও কিন্তু তার বয়েই গেছে। মন বড্ড অস্তির-অস্তির করছে। তবে মনেরই বা কী দোষ! সকাল থেকে মনের উপর যা ধকল যাচ্ছে।
এক মাসতুত ভাই পাপ্পাকে টেক্সট করলাম পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে। সে সঙ্গে সঙ্গে জানায়- ‘সাত সকালে জব্বর খবর। সব খবর আমায় জানাস।পারলে ভিডিও কল করিস তবে মায়ের কোনো মামাই রায়গঞ্জ থাকতো বলে শুনিনি। সবাই দমদম নিবাসী বলেই তো এতকাল জানতাম।’ চা আসায় ফোন রেখে মুনিয়া চায়ে মন দেয়। একবার চায়ে চুমুক দেয় আর একবার আড়চোখে আগন্তুক মামার দিকে তাকায় এবং ভাবে ভদ্রলোক যে খুব বড়লোকি চালে চলেন বলে মনে হচ্ছে না। চোর ছ্যাঁচোর ! নাঃ নাঃ –সেরকম মনে হচ্ছে না। কারণ বা পায়ের মোজাটা আঙুলের কাছে ছেঁড়া – মুনিয়া স্পষ্ট দেখে। মুনিয়া চা খেতে খেতে আগন্তুক মামার দিকে প্রশ্ন ছোঁড়ে- ‘আপনি কী করেন?বাড়িতে কে কে আছেন? ছেলে – মেয়ে কয়টি?’ উত্তর পাওয়ার আগেই দেখি মা উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন – ‘ এই মেয়েটা কী যেন নাম তোর? এতো কিসের প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে বসে আছিস। সেই আসার পর থেকে। শুনলে গা জ্বলে যাচ্ছে। মাসের পর মাস একা একা থাকি। কেউ আসেনা। খবর নেয়না। আসার মধ্যে তুই কী যেনো নাম। মনে আসছে নামটা কিন্তু মুখে আসছে না। যাইহোক আমার সব্বাইকে নিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কেউ আসেনা। এই ভাই এসেছে। যেখানেই থাকুক,যাই করুক। সেতো এসেছে রাত জেগে এই অসুস্থ দিদির কাছে। কেইবা আসে। হঠাৎ মুনিয়া দেখে আগন্তুক মামার চোখ ছল্ ছল্ করছে। ভারি অবাক ঠেকল মুনিয়ার কাছে। তাহলে কী তার ভুল হয়েছে মানুষ চিনতে। হতেই পারে কোনো মামা হয়ত রায়গঞ্জে ছিলেন। কোথার থেকে মায়ের খবর পেয়ে হয়ত এসেছেন দেখা করতে। কিন্তু এর মধ্যে মুনিয়া আবার একটা কাজ করেছে। সত্যিই আগন্তুক যদি সত্যিকারে মামা হন তাহলে সকলকে বড্ড অনাকাঙ্ক্ষিত এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

মুনিয়ার এক বান্ধবীর বাড়ির পাশেই আমাদের থানার ওসি সাহেব থাকেন। ওসি সাহেবের স্ত্রী অনামিকার সঙ্গে মুনিয়ার বন্ধু কেয়ার আবার খুব বন্ধুত্ব। কেয়াকে মুনিয়া পুরো ব্যপারটা জানিয়েছে। সে বলেছে আজকাল দিনকাল ভালো নয়। তাই আগে থেকে সাবধাণ হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। পুরো ব্যাপারটা কেয়া আবার অনামিকাকে জানায়। আজ কেয়া ওসি সাহেবকে নিয়ে একবার মুনিয়ার মায়ের ফ্ল্যাটে আসবেন। অনামিকা একথা কেয়াকে জানিয়েছে। কেয়া আবার সেটা মুনিয়াকে ফরোয়ার্ড করেছে। ফোন বেজে ওঠে। ফোনের অপরপ্রান্তে শাশুড়িমার গলা ভেসে ওঠে- ‘ কিছু বুঝলে? আসল না নকল কী বেরোলো’ এতে?

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।