হৈচৈ ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনী তে ঈশানী রায়চৌধুরী (পর্ব – ৩)

চললুম ইউরোপ
পরদিন রবিবার…. জোর বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া, তাই বাড়িতেই…. ছেলে একবার আমাকে একবার বাবাকে জড়িয়ে ধরছে….
‘মা আমার অফিসটা খুব কাছেই জানো, সাইকেল নিয়ে দশ মিনিটে বাড়ি চলে আসব…লাঞ্চে তোমার রান্না খেয়ে আবার ফিরে যাব।তোমারাও আমার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে বেরিয়ে পড়বে কেমন…. নতুন দেশে এসেছ ঘরে বসে থাকবে নাকি! ‘ সোমবার ছেলে অফিস যাওয়ার আগে অনলাইন টিকিট কেটে দিল ভ্যান গখ মিউজিয়ামের।
11 euro পারহেড। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে ওর বাবাকে রাজি করালাম।নাহলে একা নতুন জায়গা… ওরে বাবা বাড়ি ফিরতে না পারলে! গুটি গুটি দুজনে ঢুকলাম মিউজিয়ামে। এক অনবদ্য জগত খুলে গেল আমার চোখের সামনে…. আমি মন্ত্রচালিতের মত আত্মবিস্মৃত হয়ে সেই ছবিগুলোর টানে ঘুরতে লাগলাম ফ্লোরের পর ফ্লোরে কখন প্রায় চারঘন্টা কেটে গেছে বুঝলাম কর্তার মেজাজ দেখে…. তিনি আর হাঁটতে পারছেন না। ভিনসেন্ট ভ্যান গখের শিল্পকর্মের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা এটা। বললাম,যতক্ষণ থাকতে দেয় থাকি…..পরে একদিন সকালে খোলার সময় ঢুকবো আর যতক্ষণ না চলে যেতে বলবে থাকবো… না না তোমায় বিরক্ত করবো না। জীবিতকালে স্বীকৃতির ছিটেফোঁটাও না পাওয়া মানুষটি আজ কিংবদন্তি ! একটা ঘোরের মধ্যে কাটল দিনটা… আমার মনের অবস্থা কাউকে বোঝাতেও পারলাম না।

দিন কাটতে লাগল, এখন একটু সড়গড় হয়েছি…. ছেলে শিখিয়ে দিয়েছে ‘ ‘ ‘কোথাও গিয়ে যদি অসুবিধে হয় তো তুমি এইভাবে আমার হোয়াটসএ্যাপে লোকেশন শেয়ার করবে তাহলে আমি দেখতে পাব তুমি কোথায় আছ ‘ বাপরে শুধু পিঠে ডানাই নয়, প্রযুক্তির মগজ একেবারে তৃতীয় নয়ন খুলে দিয়েছে।
আমি একটু ভোম্বল গোছের, এদেশটাকে এরা কিভাবে সমুদ্রের গ্রাস থেকে বাঁচাচ্ছে আবার সমুদ্রের গা থেকে জমি বের করে আনছে…. এসব গপ্প চোখ গোল গোল করে শুনি…. তবে কেবলই চোখ চলে যায় পারিজাত ফুলেদের দিকে। এদেশের শিশুরা সব ‘বাঁধনছাড়া বনের পাখি। ‘ নিজেদের মত হাঁটছে, ছুটছে নাচছে , অভিভাবকরা শুধু সুরক্ষা দিচ্ছে। ধমকধামক কি ভয় দেখানো এসবের বালাই নেই। আমাদের দেশে হলে! সেখানে বাচ্ছাদের বকুনি দেওয়া তো পবিত্র কর্তব্য বড়দের। ইস সাধে কি আমরা পিছিয়ে আছি! ইউরোপে নাকি এসব আইনবিরুদ্ধ।
পরের উইকএন্ডে ঠিক হল Belgium যাব। Brussels আর Bruges যাওয়া হবে। রাতের বাসে রওয়ানা দিলাম আমরা। সিটে বসে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছি হঠাৎ স্পষ্ট বাংলায় একটি মেয়ে জিজ্ঞাসা করল আপনারা বাঙালি? তাজ্জব! দেখি একটা ফুটফুটে মেয়ে মাথার লাল টুপিটা খুলে হাসছে। আমি তো গ’লে গেলাম….আহা কি মিষ্টি মেয়ে! বলল ওর বাড়ি বর্ধমান, এখানে পড়াশোনা করতে এসেছে। মাসিমেসো থাকে বেলজিয়ামে, তাই Weekend এ যাচ্ছে । ছেলের দিকে তাকালাম, গম্ভীর। ঠিক বুঝেছে মায়ের মাথায় এবার কি ঘুরবে! বাবারে বাবা বড় হয়ে গেলে ছেলেপুলেগুলো যদি একটু কথা শোনে!তবে আমিও চুপিচুপি ফোন নাম্বারটা নিয়ে রাখলাম। যাই হোক সময়মতো পৌঁছালাম ব্রাসেলস, বেলজিয়ামের রাজধানী।ইউরোপিয়ন ইউনিয়নে আসার পর NATO র ত্রৈমাসিক বৈঠকও হয় এখানেই। ঠিক সময়ে নামলাম, বিশাল বাসস্টেশন আর ট্রেনস্টেশন একসঙ্গে। বাবাই বলল মা, হোটেলে যেতে রাত হয়ে যাবে খাবার নাও পেতে পারি। এসো এখানে Kfc তে খেয়ে নিই …খাওয়ার আগে ঘটল এক বিপত্তি।
আমার wc যাওয়ার দরকার….. খোঁজ খোঁজ ছেলে আর আমি একবার এদিকে একবার ওদিকে যাই! কি মুশকিল রে বাবা,এতবড় স্টেশন একটা টয়লেট নেই!হঠাৎ কয়েকজন security cop কে দেখে জানতে চাইলাম, ওরা একটা দিক দেখিয়ে দিল। বাবাই বলল ‘মা, তুমি খাবার জায়গায় নিজে আসতে পারবে? আমি বরং ওয়েট করি।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় দুলিয়ে দিলাম…. এই তো এলাম আর যেতে পারবো না! সাব্যস্ত হয়ে, নিশ্চিন্তে ফেরার পথ ধরলাম… ওমা কেমন।
অন্যরকম লাগছে ! উল্টোদিকে গেলাম… না এদিকেও তো নয়। কয়েক জনকে দেখলাম ট্রেন ধরার জন্য তাড়াতাড়ি যাচ্ছে। নিজেকে বললাম,মাথা ঠান্ডা কর। অগত্যা ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল বের করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম ওটা আমি খাবার টেবিলেই রেখে এসেছি। ব্যস আমি স্ট্যাচু ।প্রায় আধঘন্টা পর আমার বিপদবারণ ঠিক উদ্ধার করল আমায়।মনে মনে ভাবলাম আমার মত তালকানা মায়ের পেটে যে এমন ঠিকঠাক ছেলে কিকরে হল ! তখন ছেলের হাত ধরে গটগট করে খাবার জায়গায় ফেরত এলুম। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে দিব্বি চিকেন র্যাপার খেয়ে উঠে দাঁড়ালুম। নইলে কি আর রক্ষে ছিল! গিয়ে উঠলুম হোটেল Van Belle, চমৎকার!