হৈচৈ ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী তে ঈশানী রায়চৌধুরী (পর্ব – ১৫)

চললুম ইউরোপ

রাত প্রায় সাড়ে আটটায় আমরা ইন্টারলেকেন ওয়েস্ট স্টেশনের কাছেই আমাদের আস্তানায় পৌঁছালাম। নাম ডাউনটাউন হস্টেল ( Downtown Hostel ) সেলফ চেকইন ব্যবস্থা। বাবাই একটু বুঝে নিয়ে ভেতরে ঢোকার বন্দোবস্ত করল আর আমি ভাবতে বসলাম ভাগ্যিস আমার মত বোকা হয়নি!
চমৎকার হোটেল তবে টয়লেটটা এত ছোট যে বেশ কসরৎ করে ব্যবহার করতে হয়। ছেলে তো এখন বাবা তাই আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে চলে গেল ম্যাকডোনাল্ডে। আমরাও দিব্বি ছোট হয়ে আছি, ফুরফুরে মেজাজ।
এই ইন্টারলেকেন শহরটা পাহাড়ঘেরা এক আশ্চর্য ভ্যালি। নামের মধ্যেই এর পরিচয় আছে। সুইতজারল্যান্ডের মাঝামাঝি জায়গায় এর অবস্থান ; একদিকে থুন লেক আর অন্যদিকে ব্রিঞ্জ। এই দুই পান্নারঙের হ্রদের মাঝে একফালি উপত্যকা এই ইন্টারলেকেন। পর্যটনের চুম্বক ছড়ানো চতুর্দিকে। অসাধারণ বোট-ট্যুর , ছবির মত পর্বতশীর্ষের ফিউনিকুলার রাইডস। এই শহর সুইতজারল্যান্ডে সবচেয়ে পুরোনো আর সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রীষ্মাবকাশ উপভোগের ঠিকানা। বহু প্রাচীন টিম্বার হাউস আর পার্কল্যান্ড আছে আরে (Aare)নদীর দুপাশে। পাহাড় আর ঘন জঙ্গলের বেষ্টনীতে এক স্নিগ্ধ জনপদ। আল্পসের হিমবাহ আর চমৎকার অবতরণভূমি স্কিয়ারদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। তিনটে রাজকীয় পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে এই উপত্যকার চারপাশে।
( Eiger, Monch, and Jungfrau ) যা শহরের যে কোন জায়গা থেকে দেখা যায়।

পরদিন 24th ডিসেম্বার আমরা ইন্টারলেকেন ওয়েস্ট থেকে ইন্টারলেকেন oost (East) এ এলাম। বাঃ কি অসাধারণ তুষারকিরীট দেখা যাচ্ছে স্টেশনে দাঁড়িয়েই! মালপত্রগুলো বাবার পাহারায় রেখে আমাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল ছেলে স্টেশন লাগোয়া শহর দেখাতে। যত বলি ওরে ট্রেনের সময় হলে কি করে ফিরব? আমি কি তোর মত দৌড়াতে পারি! তো কে শোনে কার কথা! এক কথা… আমি তো আছি মা। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছি আর প্রায় রণপা- য় হাঁটছি। নদী, ব্রীজ,পাহাড় সুইস ঘরবাড়ি… কত কি দেখে ফেললাম অল্প সময়ে। নিজেও অবাক আমিও তাহলে উড়তে পারি… ভাগ্যিস বাবাই হাতটা ধরে রেখেছিল। ফেরার পথে ট্রেনের শব্দ শুনে দৌড় শর্টকাট দিয়ে। হাঁফাতে হাঁফাতে প্লাটফর্মে এসেই ট্রেনে উঠে পড়তে হল….. বকুনি দেওয়ার সময় পেলেন না সিনিয়র । তবে পথে হল দেরি অর্থাৎ ট্রেন অনিবার্য কারণে কিছু দেরি করায় আমরা কানেক্টিং ট্রেন মিস করলাম। ব্রিগ স্টেশনে নেমেই ছেলে বলল বাবা মা তোমরা পারবে চার মিনিটের মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে অন্য ট্রেন মানে Glacier Express ধরতে ? আমার তখন সাহস বেড়ে গেছে। ছুট… ছুট ওরে বাবা বাইরে তো বরফ পড়ছে আর রাস্তা পিছল। মিস্টার মহারাজকে বললাম… চলো আমরা চেষ্টা তো করি! খুব বেশি হলে ট্রেনটা পাবো না। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে আর কয়েক কদম কিন্তু যদি ছেড়ে দেয় !যাই হোক নিরাপদেই অবতীর্ণ হওয়া গেল গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেসে। এই ট্রেন হল ডাইরেক্ট এক্সপ্রেস দুটো মেজর পার্বত্য স্টেশন জারম্যাট ( Zermatt )আর সেন্ট মরিজ(St. Moritz ) এর মধ্যে। তবে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য এ্যন্ডারমট ( Andermatt )।

এটা ইওরোপের সবচেয়ে ধীরগামী ন্যারোগেজ ট্রেন। ২৯০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে লাগে সাড়ে সাত ঘন্টা। মনে হচ্ছে হিমযুগ পেরোচ্ছি। কত শেডের বরফ দেখলাম বলতে পারবো না। মাইলের পর মাইল আল্পসের এই তুষারদিগন্তে এত নিরাপদ ট্রেন কি করে চলে কে জানে ! ওবেরাল পাস পেরোচ্ছি, তবে এখন আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। পরের স্টপে আমরা নামলাম ডিসেন্টিস ( Disentis)। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়া আমরা দেখি….। ওরে বাবা এ যে প্রায় ঝমঝম করে বরফ পড়ছে!
প্লাটফর্ম যেখানে শেষ সেখান থেকে রেললাইন মনে হচ্ছে বরফের ভেতর সাপের মত শীতঘুম দিচ্ছে।
এত হাতের নাগালে জ্যান্ত বরফ আমি কি আর ঠিক থাকতে পারি! ভয়ে ভয়ে দু-এক পা দিয়েই কনফিডেন্ট ! বাবাই এখন ট্রেন আসবে না তো….. শিডিউল দ্যাখো । ছেলের সিগন্যাল পেয়ে নড়বড় করতে করতে চলেছি… কাঁধের ব্যাগটা খুব ঝামেলা করছে। ছুঁড়ে দিলাম বরফে, ছেলে পিক আপ করল।
একটা ষাট বছরের খুকিকে দেখে আমার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে খুব এনজয় করছে। ভাবলাম,তোর বাবা তো আর এসব আনন্দ নেবে না… গম্ভীর হয়ে ফুডশপে বসে থাকুক… তিনি ভদ্রলোক। আমি আপাদমস্তক উপভোগ করছি ডিসেম্বারের সুইতজারল্যান্ড। মাঝে মাঝে গা ঝাড়া দিয়ে নিচ্ছি যাতে ওভারকোট আর টুপি থেকে বরফ ঝরে যায়। রাস্তায় দ্যাখেন তো একটা প্রাণী কেমন গা ঝাড়া…….

আমাদের পরের স্টপ, খুর (Chur )। এটা একটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট জাংকশান এই রেলপথে। ১৮৫৮ সালে তৈরী হয়েছিল। সুইস ফেডারাল রেলওয়ে ও আরও অনেকেই এই রেলপথ পরিচালনা করে।
চুর বা খুর স্টেশনে ট্রেন বদল করে আমরা গেলাম জুরিখ ( Zurich)। আবার সেই লেক দেখার জন্যে ট্রেনের ডানদিকে বসলাম…. দেখছি জুরিখ লেক। লেকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকবেই ট্যুরিস্টদের কারণ সুইতজারল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণ এখানকার অতলনীল লেকগুলো। পাহাড়ের শরীর থেকে নেমে জলধারা এখানে আকাশের সঙ্গে কথা বলে আর নানা বিভঙ্গে উপত্যকা জুড়ে রাখে। না, এখানে এখন আমরা শহর দেখতে আসিনি। পরে সে পরিকল্পনা তো আছেই।এখানে রাস্তা বদল করে আমরা নামলাম বার্ন ( Bern ), সুইতজারল্যান্ডের রাজধানী। আসলে আমাদের এই মজার খেলা… ট্রেনে চড়, নাম, চোখের শাটার ওঠাও – নামাও আবার ট্রেনে উঠে ছুট…. হোল ডে ট্রেন টিকেট পুরো উসুল করে ছেড়েছি আমরা।