রম্য রচনায় ইন্দ্রানী ঘোষ

অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে
মানুষের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল কিছু রহস্য, কিছু প্রশ্ন যা অধরা, আবছা থেকে যায় ঠিক যেমন পাহাড়ের অলিগলি, অন্ধিসন্ধি থেকে বেড়িয়ে পড়ে মেঘেরা, কুয়াশারা, কত অচেনা, কত অজানা তো লুকিয়ে থাকে তাদের গায়ে, তাদের পরতে পরতে । তা এই অচেনা, অজানাদের ভয় পেতে নেই, বরং তারা যেমন আছে, তেমনি তাদের থাকতে দিতে হয় । তাদের দেখা পেলে, সুখ, দু:খের দুটো কথা হলেই বা মন্দ কি ।
আমার চেনা এক দিদিমণি এরকম অচেনার গল্প অনেক জানেন । তাঁর জীবনের অনেকখানি কেটেছে পাহাড়ে । কলকাতার ইস্কুলে পড়াতেন তারপর চাকরী নিয়ে সোজা পাহাড়ে । আর পাহাড় বলতে একদম সটাং পাহাড়ের রানী শৈল শহর দার্জিলিঙে তিনি থিতু হয়ে বসলেন ।
সে সময়তে মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়েরা বাইরে চাকরী করতে যাবেন এটা খুব সহজ ছিল না । আমি যেই দিদিমণির কথা বলছি তাঁর নাম ‘ওলিয়েন্ডার’ । রক্তকরবীর ইংরেজি নাম । তা এ হেন নামের মানুষ কিছুটা ব্যাতিক্রমী তো হবেনই । বাবা, মা এবং যৌথ পরিবারের সাথে লড়াই করে শেষ অবধি তিনি দার্জিলিং মেলে চেপেই বসলেন । ট্রেণ ভোরবেলা জলপাইগুড়ি ঢুকল, স্টেশনে গাড়ী ছিল ইস্কুলের, সেই গাড়ী ওলিয়েন্ডারকে নিয়ে চলল মেঘ, কুয়াশা ভেদ করে । ইস্কুলটি বেশ বড়, মিশনারি ইস্কুল । ওলিয়েন্ডারের থাকার জায়গা হল সেখানকার কোয়ার্টারে । চারিপাশে কেউ নেই । শুধু চৌকিদার এসে তালা খুলে দিয়ে বলে গেল সে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মধ্যে ডিনার দিয়ে যাবে আর ফাদার সুপিরিয়ার কিছু শুকনো বাজার পাঠিয়ে দিয়েছেন । পরেরদিন তিনি দিদিমণির সাথে ইস্কুলের অপিসে দেখা করবেন । আজ পথশ্রান্ত দিদিমণি বিশ্রাম নিন । রাতে তুষারপাতের সম্ভাবনা আছে তিনি যেন না বেরোন । অগত্যা দিদিমণি জিনিসপত্র গোছগাছ করে, হিটারে চা করে, শীতবস্ত্রে আপাদমস্তক ঢেকে, চা নিয়ে একটু ইস্কুল দেখতে বেরোলেন । সারি সারি ক্লাশঘর পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে, সামনে ফুলের বাগান যদিও সেই সময় ফুল নেই । বরফ জমে আছে ফুলের বাগানে । ওলিয়েন্ডর দিদিমণি পায়ে পায়ে ক্লাশঘর ঘুরে দেখতে লাগলেন । হঠাৎ দেখলেন একটা ক্লাশঘরে আলো জ্বলছে । উঁকি দিয়ে দেখতে তিনি দেখতে পেলেন এক নয় দশ বছরের বাচ্চা বসে ছবি আঁকছে । ক্লাশঘরে ইজেল, ক্যানভাস, ছোট ছোট চৌকি দিয়ে ভরা । দিদিমণি বুঝলেন ওটা আর্টরুম । খানিক এগিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলেন, বাচ্চাটি ঘোড়ার ছবি আঁকছে । কি দৃপ্ত রেখার টান ওইটুকুনি বাচ্চার হাতে । কতক্ষণ দেখেছেন খেয়াল নেই । বাচ্চাটা ঘাড় ঘুরিয়ে দিদিমণিকে দেখতে পেয়েই আঁকা থামিয়ে জিনিসপত্র ফেলে রেখে ছুটে বেড়িয়ে গেল । দিদিমণি দেখলেন বাচ্চাটির মাথার চুল সোনালি, চোখ দুটো নীল । মনটা একটু খারাপ হল । এই নির্বান্ধব জায়গায় শিশুর চেয়ে ভালো বন্ধু আর কেই বা হতে পারত ।
পরদিন সকালে ফাদার সুপিরিয়ারের ঘরে সই, সাবুদ সেরে বেড়োনোর সময় ফাদারের ঘরের দেয়ালে একটা ছবি দেখে চোখ আটকে গেল তাঁর । এ তো সেই বাচ্চাটার আঁকা ছবিটা । কাল যেটা তিনি আঁকতে দেখেছেন । ফাদার দিদিমণিকে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন বললেন ‘ওটা প্রি রাফাইল আর্ট, এই ইস্কুলে তখন ইয়োরোপিয়ানদের ছেলেমেয়েরা পড়ত তাদেরি একজনের আঁকা, দেশ স্বাধীন হতে তাঁরা নিজের দেশে চলে যায়, এরকম কিছু কাজ বাচ্চাদের এখনো ইস্কুলে থেকে গেছে ।’
দিদিমণি আর কথা বাড়ান নি । সব অচেনার ব্যাখা না করাই ভালো এটা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন ।