ধারাবাহিক রম্য সাহিত্যে ইন্দ্রাণী ঘোষ (পর্ব – ১)
আমাদের পাকবে না চুল
সাজঘর সমাচার।
তা এবারের মল্লার উৎসবের সময় সারণিটি নিয়ে বেশ মজাই হল। মঞ্চ পাওয়া গেল নির্ধারিত সময়ের একঘণ্টা পরে। মঞ্চআধিকারিকরা মঞ্চ ধুয়ে মুছে দিতে দেরি করলেন, ফলত আমরাও পিছিয়ে গেলাম একঘণ্টা। অনুষ্ঠান শুরু হতে দেরি অগত্যা আমাদের স্থান সাজঘরে এবং সাজঘর মানেই নরকগুলজার।
আমাদের মৃগনয়নী বান্ধবী দেবযানী মুহূর্তে মুহূর্তে রূপ বদলাচ্ছিল । কখন ‘অমিত রে’ কখন অভিসারের ‘উপগুপ্ত” ( করুণা কিরনে বিকচ নয়ান)। তা এ হেন রূপ বদলে আমরা যখন মন্ত্রমুগ্ধ তখন দেখা গেল সন্ন্যাসীর চূড়া মাথায় বেঁধে একটি অতি মলিন শাড়ী পড়ে মৃগনয়নী দেবযানী দেবী বেড়িয়ে যাচ্ছেন , আর তাঁর কান ও গালের মাঝামাঝি ‘অমিত রে’ র জুলপিটি দৃশ্যমান। দেবযানী র কচ ( জয়ন্ত) অবশ্য স্বপুত্র দেবযানী কে রথে চড়িয়ে নিয়ে গেলেন।জুলপি, টুল্পি তাঁর চোখে পড়ে না। শুধু আজও দেবযানীর চোখ তাঁর চোখে পড়ে।
এরপর আমাদের ডাকসাইটে ডাক্তার বাবু চিরন্তন যিনি একটি নবমবর্ষী বালিকার পিতাও বটে একটি সজরে ধমক খেলেন। চিড়ে( এ নামে শুধু আমরাই ডাকার সাহস পাই), তাঁর কন্যা সম্পূর্ণার সিনথেসাইজারটি ঠিক করে দিতে গিয়েছিল। তা সে একরত্তি মেয়ে বলেছে ‘তুমি যাও তো। আমি একা ঠিক সামলে নেব’ । আমরা দেখলাম চিড়ে বাংলার পাঁচের মত মুখটি করে আমার আর অর্ণবের পাশটিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা আর রাখী ( চিরন্তনের সহধর্মিণী) দেখে হেঁসে গড়াই। কটকটে চিড়ে ভাজা ভিজে কাত। সত্যিই সম্পূর্ণা সার্থকনামা।
আমাদের দলের নৃত্য পরিচালিকা সোমা তাঁর ছাত্রীদের এবং আমার কন্যাকে দারুন পরিচালনা করেছিল। সোমা নীল বেনারসিতে বাসবদত্তা সেজে শেষ দৃশ্যে দুচোখে প্লাবন ডেকে সে এক মহাকাণ্ডই করল। আর সোমার ছয়জন ছাত্রী অনুষ্ঠান শেষে যেভাবে দৌড়ে ট্রেন ধরতে গেল তা দেখে হুসেন বোলট লজ্জা পেতেন। আমি তাদের হাতে টিপিনের প্যাকেট দিতে গিয়ে দেখলাম হাতগুলো বরফের মত ঠাণ্ডা। ট্রেন খুড়োর কলের থেকেও সাঙ্ঘাতিক।ওদের নাচ (উদয়শঙ্কর শৈলীতে) এবং সাজ প্রশংসনীয়।
আমাদের দুই গায়িকা সুচরিতা ও পুঁচকে অন্বেষা ( অর্ণব ,সৌমির কন্যা) কিন্নরকণ্ঠি । দর্শকেরা এদের গানে অভিভূত। চিরন্তন অর্ণব,শতদ্রুর মেঘমন্দ্র কণ্ঠস্বরে মল্লার উৎসব মেতে উঠেছিল।
এবার আসি শুভজিতের কথায়। শুভজিতের একটি তিন বছরের কন্যা আছে আর ছোটটি একমাস আগে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তাঁরা দুজনেই এখন মামাবাড়িতে। ফলত শুভজিতের পিতৃহৃদয় কন্যাদের বিরহে কাতর। তা এ হেন সময় নীলাম্বরী রঙা শাড়ী পরিহিতা একটি ক্ষীণকায়া কন্যা অতি কাঁচুমাচু মুখ করে শুভজিতের সামনে আসে, তাঁর অনুরোধ তাঁকে একটু আগে জায়গা দিতে হবে মঞ্চে, তাঁর হস্টেলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে রাত বাড়লে, তাঁকে ফিরতে হবে। শুভজিত মঞ্চ সামলাচ্ছিল। শুভজিত শেক্সপিরিয় নায়কের কায়দায় বলল ‘ তুমি ওয়ার্ডেন কে বল তুমি তোমার বাবার সাথে আছ। এখন আমি তোমার বাবা” । সে মেয়ে তাঁর নব্যপিতাকে দেখে আরও ঘাবড়ে গিয়ে কেঁদে ফেলে আর কি। যাই হোক পরে জানা গেছে সে অনুষ্ঠান শেষে ঠিকমত হস্টেলে পৌঁছেছে।
আমাদের সব পাগলামি মঞ্চে এবং মঞ্চের বাইরে সামলেছে রাখী( রাখী পাঠও করেছে) সৌমি,শতাব্দী ।
অনুষ্ঠান দেখতে এবং আমাদের পাগলামিতে আস্কারা দিতে এসেছিল রুমা (শাশুড়ি মা এবং ছেলে সহ), শুভঙ্কর ও সুদিপেন্দ্র এসেছিল সপরিবারে।আমুল ( অম্লানকুসুম) আমাদের মঞ্চে ওঠার সাথে সাথেই উদয় হয়েছিল এবং আমাদের সাজঘরে ভুবনভোলানো হাসিটি হেঁসে হাওয়া হয়ে গেল।
সবশেষে ‘নন্দিনী’র কর্ণধার আমাদের বন্ধু ‘ইনা’ কে অভিবাদন জানাই। এতবড় কর্মকাণ্ডে আমাদের সহ্য করার সাহস দেখানোর জন্য। তোঁর অদম্য ইচ্ছেশক্তিকে সেলাম । তোর চিত্রাঙ্গদা, রাধা, লাবন্যর জয় হোক।