|| শাম্ভবী সংখ্যা ২০২১ || T3 শারদ সংখ্যায় ঈশানী রায়চৌধুরী

আমার দূর্গা
আমার তখন প্রাইমারি…. সবাই বলত মেয়েইস্কুল….. কিন্তু সেই ইস্কুলে তখন মন টেকে না…. যদি চোখ আঁকা হয়ে যায়! স্কুলে যাওয়ার সময় রোজ জিজ্ঞেস করতুম ” ও মোহনকাকু, কবে চোখ আঁকবে গো? ” মোহনকাকু হাল্কা হাসতো… “মা যেদিন বলবে ” চুপিচুপি ছোটপির কাছে বায়না করতুম তুমি বলে দাও না কবে চোখ আঁকবে…. ইস্কুলে থাকলে যে দেখতে পাবো না!
ছোটপিপি একদিন বুদ্ধি দিল, মা দুগ্গা কে বলে যা দেখবি ঠিক দেখতে পাবি।
তাই করলুম আর নির্ভয়ে ইস্কুলে চলে গেলুম!
তখন পুজোর সময় রোজ রোজ বাড়ি বদলে যেত… সকালে একরকম বাড়ি ছিল … বিকেলে এসে দেখি নারকেলপাতার ঘেরাটোপ লেগে গেছে… মানে আমাদের বাড়ির মাঝখানে যে উঠোন তার একদিকে ঠাকুরদালান, একদিকে ভেতরবাড়ি, নিরামিষ রান্নার দালান ইত্যাদি…. উঠোনটা অর্ধচন্দ্রাকার করে বাঁশের বাঁখারি আর কাঁচা নারকেলপাতা দিয়ে ঘেরা হত…. নাহলে পুজোর দিনগুলোতে বাইরের অনেক লোক বাড়িতে আসে, বাড়ির বউ ঝি রা তাহলে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারবে না।
উঠোনভর্তি বড় বড় ঘাস ছিল পাড়ার ছেলেরা কদিন দাপিয়ে খেলে নেড়া করে দিতো। স্তূপাকার নারকেল পাড়িয়ে রাখা ছিল.সেগুলো আস্তে আস্তে কমতে থাকতো। দেড়হাত লম্বা লোহার সাঁড়াশি দিয়ে প্রায় শ’খানেক শুকনো নারকেল ছোলা হত , মানে ছোবড়া আর নারকেল আলাদা করা হত…. আমরা ঠাকুরদালানের বাঁশের খুঁটি ধরে চোখ বড় বড় করে দেখতুম…. পাড়ার কাকাদের হাতে কি জোর!
আসলে আশে পাশের দুতিনটে গ্রামের মধ্যে তখন এই একটাই দূর্গাপুজো। তাই ভাবখানা ছিল যেন পাড়ার সবার পুজো। দিন পনের আগে থেকে পাড়ার বয়স্ক ঠাকুমারা এসে আমার ঠাকুমা (আমরা বলতুম ‘বৌমা ‘)র সঙ্গে মাটির দোতলায় বসে পুজোর দেড়মন আতপচাল বাছতেন, খই বাছতেন। প্রথমে চালনিতে ঘষে ঘষে খইয়ের থেকে ধান আলাদা করা হত। সঙ্গে কত গল্প, সেখানে অবশ্য আমাদের প্রবেশাধিকার ছিল না, কারণ আমাদের জামাকাপড়ের কি ঠিক আছে! অবশ্য আমাদের মানে স্কুলপড়ুয়া ভাইবোনদেরও কাজ ভাগ করা ছিল…. সেগুলো পরে বলবো।
পুজোর আগে যে ছুটির দিন পড়তো…সেদিন কাকারা গামছা আর কলসি নিয়ে, খালি পায়ে ট্রেনে করে হাওড়ায় যেতেন গঙ্গাজল আনতে…. কারণ ” গঙ্গার পশ্চিমকূল, বারাণসী সমতুল “। কাকারাই মুড়কি তৈরী করতেন… নতুন চাটাই পেতে বেছে রাখা খই ঢেলে দিতেন, আর আমার ছোটঠাকুমা কাঠের জালে গুড় পাক দিয়ে সেই খইয়ের ওপর ঢেলে দিতেন আর উফ সেই গরম গুড় দুহাত দিয়ে কাকারা মাখতেন… তৈরী হত মুড়কি, তারপর নতুন মালসায় মুড়কি ভর্তি করা হত তার ওপর নাড়ু দিয়ে তৈরী রাখা হত এইকদিনে যে সব লোক আসবেন তাঁদের দেওয়ার জন্যে।
অনেক অনেক দৃশ্য.. অনেক কথা লুকিয়ে আছে একশো কুড়ি বছরের প্রাচীন এই পুজোর।
চারপুরুষ ধরে আয়োজক বসুপরিবার।
চারপুরুষ পুজো করছেন মেদিনীপুরের ভট্টাচার্য পরিবার।
আমরা দেখেছি পুরুষাণুক্রমে মালাকার, ঢাকি, নাপিত, যদিও বর্তমানে অনেক পরিবর্তন ঘটাতেই হয়েছে কালের প্রয়োজনে।
পরিবর্তন হয়নি শুধু এই বিশ্বাসের যে মা নিজে দয়া করে আসেন…. তা নাহলে মধ্যবিত্ত এই পরিবারের সাধ্য ছিল না এই স্বপ্ন দেখার!
এ বছর ১২০ বছর, কালের হিসেবে খুবই নগন্য।