অভয়দা, আমাদের পাশের পাড়ায় থাকে। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়, বেশী পড়াশুনো করতে গিয়ে নাকি পাগল হয়ে গিয়েছিল। শান্ত পাগল। আমরা এই পাড়ায় এসে অবধি এমনটাই শুনেছি। একদিন আমাদের খেলার মাঠের লাগোয়া, ক্লাব-ঘরের পাশে, বাউন্ডারির থেকে বল কুড়োতে গিয়ে আরো কিছু শুনলাম – ক্লাবের ছেলেদের আলোচনা কানে এসেছিল – বেশীসময় কাটালাম ঝোপ থেকে বল খোঁজার অজুহাতে। আড়ি পেতে শোনার ঔৎসুক্য। এই ঔৎসুক্যের একটা কারণ, অবশ্য বাড়িতে একুশে-আইন মাফিক নিষেধ, ক্লাবের দাদাদের আলোচনা যেন না শুনি।
আমি তখন ক্লাস সেভেনএ উঠব। পুজোর ছুটির ঘটনা।
আমাদের বাড়ির পাশের মাঠের একদিকে, নিরুপমা-দি-দের বাসা। বাসা বলছি, কারণ, ওরাও আমাদের মতন ভাড়াটে ছিল। ছোটবয়সে বাবা বুঝিয়েছিলেন – যে বাড়িতে সাময়িক আশ্রয়, যেটা নিজেদের নয়, সেই বাড়ি হল বাসা। আমি বর্তমানে ও, সেই অর্থে একটি বাসায় থাকি। বাবা বলেছিলেন – পাখি যেমন, মন চাইলে বাসা পরিবর্তন করতে পারে! মনে ধরেছিল বেশ, এই উপমাটা।
ফিরে আসি নিরুপমাদির কথায়।
মা-কাকিমাদের আলোচনা শুনেছিলাম, নিরুপমাদিরা তিন বোন আর এক ভাই। ওদের বাবার একার টাকায় সংসার চলবেনা বলে নাকি নিরুপমাদি টিউশনি করত। তাছাড়া, আমি তাকে উনান ধরাতে দেখেছি, দুধ আনতে যেতে, পুকুরে কাপড় কাচতে আসতে দেখেছি। আর শুনেছিলাম নিরুপমাদি, ভালো গান গাইত – কিন্তু তার ভাই হারমোনিয়ামের শব্দে পড়াশুনোয় মন দিতে পারবেনা বলে গান গাওয়ার মত তুচ্ছ সাধ শিকেয় তুলেছে, নিরুপমাদির। এই ঘটনাগুলোর একটাও আমার এই গদ্যে নিরুপমাদিকে স্থানাধিকার দেয়নি। যেমন তার কর্মপটুতা ও স্নিগ্ধাপ্রতিমা তাকে সংসার করার অধিকার দেবার জন্য যথেষ্ট ছিলনা।
যেমন শুরু করেছিলাম – ক্রিকেট বল কুড়োতে গিয়ে শুনলাম দেবুদা ক্লাবঘরে বসে বলছে – আসলে ওই অভয় আর নিরুপমার ব্যাপারটা, কোনদিন কেউ মেনে নিতে পারবেনা, তবে এইসব কি চেপে রাখা যায় রে? দেখিস না ওইদিকে দোকান যেতে গেলে, ওই মেয়েটা কেমন অভয়দের বাড়ির গা ঘেঁসে হাঁটে। সত্যি বলতে, দেবুদার এই কথার মানে তখন বুঝিনি – কিন্তু মন:স্থির করেছিলাম একদিন বিকেলে নিরুপমাদিকে দোকানের পথে অনুসরণ করবো।
যেদিন অনুসরণ করলাম, দিনটা ছিল বেশ কয়েক মাস পরে, আমার ক্লাস সেভেনের এর গ্রীষ্মকালীন ছুটি ।
নিমকি বিস্কুট কেনার অজুহাতে, খেলার মাঠ থেকে পিছু নিলাম – কয়েক পা সামনে নিরুপমাদি। ধোপার পুকুর ছাড়িয়ে রাস্তাটা যেখানে বাঁদিকে তেরছা হয়েছে, সেখানে একটা জোড়া-অশ্বথ গাছ। তার নীচে লাল সিমেন্টের বেদি। এখানে গরমের দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার সময় অনেক মানুষকে আয়েশ করে তন্দ্রাচ্ছন্ন বিলাস ভোগ করতে দেখেছি। কখনো কখনো আমার ও ইচ্ছে করত এখানে বসে পড়তে। এই গাছের নীচে বসে পড়লাম আমি – দেখতে পাচ্ছি, অদূরে মিন্টুদার দোকানে নিরুপমাদি ও রয়েছে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ শচীন কর্তার গান গাইতে শুরু করল – দেখি ওদের বাড়ির জানলার পাশে বসে নিখাদ কন্ঠে গান গাইছে অভয়দা। কিন্তু পাগল তো, যদি আমাকে দেখে কিছু বলে – যদি বাইরে আসে! উঠে আবার বাড়ির রাস্তায় কিছু দূর গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম, গানটা শুনে যাবো বলে। সেই গানটা শেষ হতেই বুঝতে পারলাম একটা হারমোনিয়াম বেজে চলেছে। এর ফাঁকে আমার দাঁড়িয়ে থাকা রাস্তার বাঁকের কাছাকাছি ফিরতি পথে নিরুপমাদি। অভয়দা পরের গান ধরতেই, আচমকা থেমে, জোড়া-গাছের নীচে বেদিতে বসে পড়ল নিরুপমাদি। এখন ও মনে পড়ে – সহজ ঢঙে, ঈষৎ মাথা ঝুঁকিয়ে, এক হাত আর্ করে , আরেক হাত গালে। ঠিক যেন “সে সুরের ও মায়াডোরে রাধা বিবসা, চকিতা হরিণিসম থামে সহসা!”……….
আমি ভাবছি এরপরে কী হয়েছিল ? মনে পড়েছে, নিরুপমাদির পিঠ-বেয়ে বিকেলের রোদ, অমলিন মুখটা একটু উপরে তুলে গান শুনছে – মাথার উপরে গাছের পাতাগুলো ঝুঁকে পড়ে যেন খোঁজ নিচ্ছে কোন রচনার । সে রচনার সম্ভাবনা সীমাহিন …ওদের সব-পাড়াতেই এক ই অবস্থা….অভয়দা শান্ত পাগল, আর অনুপমাদির তখন ও বিয়ে হয়নি…….। অনেকে বলত গান না গাইতে দেওয়ার অভিমানে, নিরুপমাদি নাকি একদিন সন্ধ্যাবেলা, নিজের হারমোনিয়ামটা পুকুরে ফেলে দিয়েছিল?!
শুক-সারি পাখির মুখে শুনলাম, আসলে সেইদিন হারমোনিয়ামটা কাউকে দিয়ে দিয়েছিল নিরুপমাদি। সেই সন্ধ্যার অন্ধকার, অশেষ করেছিল তাদের সঙ্গীত ও যৌবন।।