গ্রীষ্মের দুপুরে মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতো। আমি কিছুতেই ঘুমাতে চাইতাম না। জানি একবার ঘুমিয়ে গেলেই বিকেল হয়ে যাবে। মা জোর করে ঘুম পাড়াতো। এক একদিন ঘুমিয়ে যেতাম। বেশিরভাগ দিনই ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম। যখন বুঝতে পারতাম মা ঘুমিয়ে গেছে তখন আস্তে আস্তে মায়ের পাশ থেকে উঠে পা টিপে টিপে ঘরের বাইরে। আমায় আর পায় কে। কোনো কোনো দিন পানপুকুরের পারে আবার কোনো কোনো দিন সোজা বেনেপুকুরের পারে। কোনো গাছের নিচে এসে চুপ করে বসে থাকতাম। চারপাশে কোনো জনপ্রাণী নেই। কে-ই বা আর থাকবে। ওই রোদ আর গরমে কে-ই বা আর চারদেয়ালের বাইরে পা রাখবে। তাই একা একা চুপচাপ বসে থাকতাম। খুব ছোটবেলা থেকেই বেশি কথা বলা পছন্দ করতাম না। তাই এটা ছিল আমার কাছে খুব শান্তির জায়গা। গলায় একটা গামছা নিয়ে বের হতাম। কখনও কখনও সেই গামছাটা মাটির ওপর পেতে নিয়ে তার ওপর শুয়ে পড়তান। কোনো দিন ঘুমিয়ে পড়ি নি। শুয়ে শুয়ে গাছের ভেতর ঘরে নজর দিতাম। অন্য যখনই গাছ দেখতাম সেটা তো গাছের বাইরের বারান্দা। সেখানে গাছ সেজেগুজে এসে দাঁড়াত। গাছের গোড়ায় শুলে তার শোবার ঘরে ঢোকার সুযোগ পাওয়া যেত। দেখতাম ডালপালাগুলো কি সুন্দর ভাবে একে অপরের সঙ্গে লেগে আছে। দেখতাম কত পাখি গাছবাড়ির ভেতর ঘরে ঢুকে বিশ্রাম নিচ্ছে। গাছকে তখন সত্যিই মায়ের মতো মনে হতো। আমিও যেন তার কাছে এসে আশ্রয় নিয়েছি। এসব দেখতে দেখতেই কখন যে সময় চলে যেত বুঝতেও পারতাম না। সন্ধে হলে বাড়ি ফিরতাম। না জানিয়ে না ঘুমিয়ে ভরদুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রায় রোজই কিছু না কিছু শাস্তি পেতাম। কোনো দিন সেই শাস্তি
গায়েও লাগে নি, মনেও লাগে নি। তাই পরের দিন আবার মায়ের পাশ থেকে পালিয়ে যেতাম।
কতদিন গাছের নিচে গামছা পেতে শুই নি। এখনও দুপুরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। তবে লুকিয়ে লুকিয়ে নয়। নিজের ইচ্ছামতো স্বাধীনভাবে। আজও সারাটা দুপুর কোনো নির্জন স্টেশনে চুপচাপ একা একা বসে থাকি। তবে গাছের নিচে নয়। খুব ইচ্ছা করে একদিন গাছের নিচে বসে বসে গাছের ঘরকন্নার খবর নিই। তবে গাছ আজ আর আমাকে ঢুকতে দেবে কিনা জানি না।