• Uncategorized
  • 0

কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক ভ্রমণ) (প্রথম পর্ব) গোবিন্দ ব্যানার্জী

রূপকথার গাঁয়ে পাঁচদিন

তাপসদা… মনে আছে? বিষ্ণুপুরের সেই মধ্যরাতে নিশ্চুপ রাস্তা। পথ পাশের বাড়িগুলো কেমন যেন ঝিম ধরা। মাকড়সার জালের ভিতর থেকে, কোন দূর অনির্দিষ্ট থেকে, অথবা আমাদের পূর্বকথনের রেশ ধ’রে অন্ধকার ছেয়ে ফেলছিল… আর আলো ছুঁড়ে দিচ্ছিল যে সব পোস্টের বাল্বগুলো… তারা ক্লান্তিতে উসখুস করছিল একটা গাঢ় ঘোরে। দরোজা বন্ধ ছিল সবক’টা দোকানের। গলির লুকোনো ভিতরে খসখস ক’রে শব্দ… তুমি আধ বোজা চোখে তাকালে, হাত বাড়িয়ে সম্ভবতঃ একটা আলো চাইলে। পকেটের লাইটার তোমার হাত ছুঁয়েই জ্ব’লে উঠল। নাঃ… আমার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে দিলে আগুন। তারপর সেটা বিনিময় হ’তে হ’তে ছিটকে চলে গেল নালার ঘোলা জলে।

সিঁড়িতে… হেলে পড়া রাতের ভিতরে, কথা ছিলনা দু’জনে বসার। এবড়ো খেবড়ো চুলের ভিতরে হাত তোমার। খেয়ালী হাসি। কোন শব্দ উচ্চারণের প্রতিক্রিয়া বা গভীর কোনকিছু বলার প্রস্তুতিও না, তবু হাসলে… সেই অন্ধকার, সেই গড়ানে রাত, সেই বসে থাকা সিঁড়ি… কিচ্ছু ছিলনা ভাবনায়। তাও ঘটে যাচ্ছে আমাদের জড়িয়ে জড়িয়ে।

দু’তিনটে পরিকল্পনা ছেঁড়াখোঁড়া হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সার্ভাইভাল ট্রেকটাও। বাতিল টিকেটের দিকে ধোঁয়া চোখে দেখি আর ছায়া মাখি ঘরময়। অথবা এমনও হয়েছে…রাত বিরেতে ফোন বাজল, বাক্যবন্ধের পরিবর্তে ক’য়েকটা শ্বাস… হতাশ… যেমন অতল সময়ের ভিতর ডোবানো ছিল একটা ইঁদারা। গল্পগুলোকে কেউই তুলে আনতে পারিনি ব’লে অপদার্থ আক্রোশে খিস্তির কোলাজ বানিয়ে ঝুলিয়ে দিচ্ছিলাম বাতাসের অস্পষ্ট দেয়ালে। তাও রোদ্দুর খুঁজি। খুঁজতে খুঁজতেই দাগ কাটি কাগজে। ফেলে দেয়া ঝুড়ি থেকে কুড়িয়ে নিই এক পিঠ জেরক্সের দোমড়ানো কাগজ। সোমনাথ ব্যস্ত, ঠিক আমার অস্থিরতার উত্তর মেরুতে ব’সে, তবে সেও গুগল সার্চে মগ্ন… কোথায়… কো থা য়…কবে…

পাক্কা। তিনটে পরিগঠন চকচক করছে, মার্কার কালিতে। নিউ মাল জংশন হয়ে চালশা, সামসিং, সুন্তালেখোলা, রকি আইল্যান্ড…. একটাতে দিব্বি “ফাইনাল’ লিখে প্রশস্ত নিঃশ্বাস ফেললাম এক জোড়া। বাড়ির বারান্দার বিকেল এসে পড়লেই বন্ধুরা আসে। অনেক রাত করে তারা, তারপর ওঠার তোড়জোড় করে। দু’তিনটে গ্লাসে তখনো পড়ে থাকে তলানি আঁকড়ে লালচে চোখ। জানিয়ে রাখি ফাঁক পেলেই… যাচ্ছি হে… যে কাগজটা অবশ হাতে উঠে আসে… তাতে তো মানচিত্র আঁকা। চশমাটা খুঁজে পেতে দেরী হ’লে মেজাজ চ’ড়ে যায়। এখানে তো নদী ছিল..ঐ খানে তলিয়ে যাবার কথা ছিল একটা পাহাড়ী ঠিকানা। মানে কাটাকুটি হ’য়ে গেছে প্রথম পরিনির্মাণ। বেশ, এটা তবে দ্বিতীয়টা… ফোন বেজেই চলে। উঠোনে আলো পড়ে। সোমনাথের স্ক্রুটি ঢুকে পড়ে গেট খুলে। রাতের কাঁটা মাঝ মধ্যিখানে।

তৃতীয় কাগজটা ওর পকেটে রেখেছিলাম, ঠিক। ওটাই সিলেক্ট। ঘুম থেকে মানেভঞ্জন হয়ে ধোত্রে। চারদিনের নিশ্চিন্ত ডুব। ঘুম। খাওয়া-দাওয়া আর অলস পায়াচারি। মোমো মোমো। ও হোঃ…

অস্পষ্ট কুয়াশার ভিতর হেলান দিয়ে আছে একটা দু’টো তিনটে ছায়া। ছায়ার রেখা ধ’রে ধ’রে নাম লিখে রাখি… স্পষ্ট হ’য়ে উঠছে, নড়াচড়া করছে একটা অবয়ব। কাঁপা জানলার ওপারে ধোঁয়াশা, তারও ওপারে কিছু নেই হয়েও রয়ে গেছে কিছু। সেখানে আনন্দ বিস্ময় আর আকাঙ্খিত উড়ান। মন খারাপের ফুলটা ফুটে ওঠার আগেই দু’জোড়া চোখের সামনে আলো হয়ে উঠছে ছায়ামানুষটা।

ব’সে আছি অনেকগুলো সম্ভাবনার সামনে। তিনটে পরিকল্পিত রুট আমাকে ছুঁয়ে পাহাড়মুখো হয়ে অপেক্ষা করছে দিন ক’য়েক। কি প্যাডে আঙুল নড়ছে। ওপাশে তাপসদার ফোন বাজছে ‘শেরপা হোম স্টে’র নম্বরহীন ঘরে। জানলার গরাদ ছুঁল বাঁ’হাত। একটা অভিনব রুট ম্যাপ… চতুর্থ প্ল্যান, জোড়থাং হয়ে হিলে ভার্সে… মানে! কাগজে দাগ কেটে ফেলার আগে গুগল সার্চ। হুড়মুড় ক’রে সোমনাথ এসে গেল। মুখোমুখি ব’সে মাথা নেড়ে সম্মত হ’লাম। সে কি উল্লাস…

এদিকে ট্রেন টাইম সকাল ছ’টা পঁয়ত্রিশ। ভোর নয়, রাত তিনটেয় উঠতে হ’ল। দেড় ঘন্টার দূরত্ব আর ঘুম চোখের ভিতরে দাঁড়িয়ে ঝিমোতে থাকে খয়েরী বিস্কুট রঙা কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস।

যে আলোটার জন্যে ঘড়ি অপেক্ষা ক’রে আছে, আর ন্যাপস্যাকের ওজন পরীক্ষা করছে কাঁধ… অন্ধকারের চাবি তালা আর গেটের সংরাগ, গাছ ও পাতার টুপটুপে কালো ছায়া। ‘চালশা’র অনিমেষ… তাকে মনে পড়ার কোন মানে নেই, এই সকাল হতে চাওয়া আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে। দেখা হয়ে যাবে তেমনিই কথা ও কথা বিনিময় What’s App.এর পাতা জুড়ে…

ভোর চারটে কুড়ি। আবছা কালোর ভিতর থেকে স্ক্রুটির আলো বেড়ে আরো…ক্রমশঃ কাছে। দেরী দেরী দেরী… এরপর যারা জীবিকার দানা খুঁটতে বেরিয়ে পড়েনি, আর আমরা ভারী ব্যাগ পিঠে চাপিয়ে এক কিলোমিটারের উৎকন্ঠিত পথ হেঁটে চলেছি। বারাকপুর থেকে শিয়ালদা অভিমুখী ট্রেন ভোর চারটে বাহান্ন।

এগার নম্বর প্লাটফর্মে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস সারা রাত ঘুমিয়ে এখন আড়ামোড়া ভাঙছে। অথবা তার জেগে ওঠাকে উপভোগ করছে আমাদের মত নির্ঘুম যাত্রীরা। দাঁড়িয়ে আছে সে উন্মুখ উদ্যমে। সারাদিনের বোঝা নিয়ে অনেকটা পথ সামনে চেয়ে আছে। সোমনাথ মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলতে তুলতে আফশোস করছে… চেয়ারে ভুল ক’রে রাখা আছে ডিজিটাল ক্যামেরাটা। পরে, সকাল খানিকটা এগিয়ে গেলে কেউ হয়তো ওটাকে দেখে একগাল হেসে উঠবে। ছবি তুলতে না পারার জন্যে খানিকটা হ’লেও চুকচুক করবে।

তবু তো ছবি উঠল। কিম্বা ছবি ওঠার জন্যে শরীর আর অনুসঙ্গ এক একটা নির্দিষ্ট কোণ খুঁজে নিতে চাইল। তারপর শুরু হয়ে গেল ঘরঘর ঝিকিমিকি ঘড়াং… ভারতীয় রেলের ঐতিহ্য মেনে দেড় ঘন্টা হেলায় হারিয়ে সে যখন নিউ জলপাইগুড়িতে পৌঁছে উগড়ে দিল সবাইকে… অহো… কী তাজা শরীর!!

ট্রেনের কামরায় নিঃঝুম ব’সে থাকা অথবা উদাসীন শুয়ে থাকা এমনকি ঘুমগুলোকে বাদ দিলে যা থাকে, তার আস্বাদন বিচিত্র। অবশ্যই ব্যক্তি ভিন্নতায় বিভিন্ন। আমার স্মৃতি জুড়ে জমতে থাকে হকারদের শব্দ সুর লয়…আর সেখান থেকে উঠে আসে লোকসুরের ইশারা। চুপি চুপি। আলতো ক’রে গুছিয়ে রাখি তাদের। তখন হয়তো শ্লথ হয়ে আসছে ট্রেনের গতি। একটা রিদম বাজছে সেই বিলম্বিত চালে। সুরটা মগজের ভিতর রিণরিণিয়ে উঠছে তার সাথে। দৃষ্টি জুড়ে তখন উদাসী একটা স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছি। কামরার আদান প্রদান হয়ে চলেছে মিলিত সুরের রেশ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।