কথা সাগরে মৎসাপুরুষ গোবিন্দ ব্যানার্জী (ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী) – পঞ্চম পর্ব

রূপকথার গাঁয়ে পাঁচদিন
সৌরভ উঠে দাঁড়াল। ও নেমে যাবে নীচে, ওদের আস্তানায়। দোহারা চেহারা। অনবরতঃ কথা ব’লে চলেছে। তারই ভিতর গুঁজে দিল একটা রহস্যময় ঝর্ণাকে। এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে… রিম্বিকমুখী পথের পাশে। সোমনাথের দিকে শব্দহীন তাকালাম। ছেলেটি ঝর্ণার কথা বলতে বলতে পাথুরে উঠোনের সীমা পর্যন্ত চ’লে গেছে। আমরা দু’জন ওর বর্ণিত ঝর্ণার জলশব্দ শুনতে পাচ্ছি। সৌরভ লাফাতে লাফাতে নেমে গেল ভেজা সন্ধ্যার পাহাড়ী গড়ানে পথে। ছায়াটা মিলিয়ে গেল, সোমনাথ বলল… মাশাই, চলুন উপরে যাই। এখনো পরিচ্ছন্ন হইনি। আর ঠান্ডাটাও জাঁকিয়ে পড়েছে…
রান্ধাঘরে ওরা মোমো তৈরীতে ব্যস্ত। ঘন্টাখানেক সময় লাগবে তৈরী হ’তে। সোমনাথ সেদিকে শব্দ উড়িয়ে দিল… উপ্পরমে যা রহা হুঁ… উন্মুক্ত সিঁড়িতে ওঠার মুখেই বাথরুম, প্রস্রাবাগার। সোমনাথ সেদিকে গেল। আমি উঠে গেলাম উপরে, সামনেই খোলা দরোজা। ভিতরটা অদ্ভুত। সজ্জিত। সেখানে একরাশ শৈশব জড়ো হ’য়ে আছে। প্রিয়ার স্বপ্ন। একটা আগামী শৈশবের স্বপ্ন। প্রচন্ড ঠান্ডা জড়িয়ে ধ’রছে সর্বাঙ্গে ন্যাপস্যাকটা রেখে দ্রুত হাত মেলে ব’সে পড়লাম আগুনের উৎসটার কাছে, আর ঠিক তখনই সোমনাথ ঘরে পা রাখল।
সোমনাথের চোখে বিস্ময়। ভারী রুকস্যাকটার পাশে ব’সে ঘরের সজ্জাগুলোতে দৃষ্টিমুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। একটা সম্ভাব্য পাহাড়ী শিশুর জন্যে বহু যত্নে সাজিয়ে রাখা ঘর এটা। এখানেই আমাদের রাত্রির গল্পকথা অপেক্ষা ক’রে আছে। দামী আর ভারী পর্দা ঝুলছে জানালা দরোজা আগলে। কিম্বা দরোজা জানালাগুলো রঙিন ভেলভেট পর্দায় খুব ক’রে সেজে উঠেছে আমাদের খুশীকে উপচে দেবে ব’লে। শৈশবের খেলনা আর পুতুলের সংসার বেশ পরিপাটি ব’সে আছে গল্প বলার অপেক্ষায়। সাগর ঢুকছে পর্দা সরিয়ে। ওর দু’হাতে গরম চায়ের বড় বড় কাপ। বাইরের একঝাঁক ঠান্ডা ঝাঁপিয়ে পড়ল দরোজা খোলা পেয়ে। ঘরের মধ্যিখানে যে কাঁচের টেবিলটা ফুলদানি জাপটে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তার জেগে ওঠার সময় হ’ল এবার। চায়ের কাপ রেখে সাগর টেবিলটা থেকে সমস্ত উপকরণ গুছিয়ে নিয়ে চ’লে যাচ্ছিল। দরোজার মুখে দাঁড়িয়ে বলল… মোমো বন্ রহা হ্যায়, আভি হো যায়েগা। রাতমে খানা ক্যা বনাউঙ্গা? সোমনাথ আমার দিকে চেয়ে বলছে… রোটি অর সবজি… কি মাশাই…? সাগর স’রে যাচ্ছে খোলা দরোজা থেকে। দরোজাটা বন্ধ হ’য়ে যাচ্ছে। সোমনাথ গোটা দুই লেপের তলায় ঢুকে পড়ল। আগুনের পাশ থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না, হাত বাড়িয়ে গরম চায়ের কাপটা টেনে নিলাম। ঠোঁটের কাছে কাপের আগ্রহ… সুঘ্রাণে মস্তিষ্কের কোষ রমরমিয়ে উঠল।
শব্দটা সোমনাথ করল… ওয়াও… দার্জিলিং…
চা পান পর্ব দ্রুত শেষ হ’য়ে গেল। শীতের কাঁপুনি আর উত্তেজনা… আগুনের সামনে ব’সে আছি… শরীরের সম্মুখটা গরম হ’য়ে উঠেছে। অথচ এখনও আমরা পথের পোশাক পাল্টানোর অবসর পাইনি। সোমনাথ ব্যাগ থেকে শীতনিবারক পোশাক বের করার জন্যে উদযোগ নিচ্ছে। অতএব আগুনের সামনেটা থেকে উঠতেই হ’ল। ওকে পোশাক পাল্টে নেবার জন্যে দরোজা খুলে বাইরে বেরুতেই শীতল স্পর্শ কুঁকড়ে দিল সারা শরীর। তবুও… সরু ফালি বারান্দার ওপারে ঘন ছায়ার মত জঙ্গল… সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে দূরে… আরো দূরে পাহাড়ের গায়ে আলোর ফুলঝুরি। এখান থেকে সেই বহুদূর চিত্রের আলোর ফুলকি দেখা যাচ্ছে। ঐ মানেভঞ্জন তারও ওপাশে বাঁ দিকে সুখিয়াপোখরি। কেমন একটা নিঃঝুম সুর লেগে আছে আলোমাখা দূরের গাঁগুলোতে। নীচে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দু’টো তীব্র আলো গড়িয়ে চলেছে…কোন গাড়ি, সোয়ারী নিয়ে
চলেছে দশমাইল কিম্বা রিম্বিকের দিকে। চলমানতা একটা নেশার মত ছড়িয়ে যাচ্ছে মনে মনে। নীচের রান্নাঘর থেকে মাঝেমাঝেই প্রিয়ার হাসি উপচে উঠে ছড়িয়ে পড়ছে নিস্তব্ধতার এই প্রেক্ষাপটটাকে সাজিয়ে দিতে। একটা কঠিন আর্তনাদের মত ধ্বনি প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল দূরের জঙ্গলের অন্ধকারে। আর ঠিক তখনই সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো সাগর ও প্রিয়া। ওদের হাতে মোমো ভরা প্লেট।
সোমনাথকে ডাক দিলাম। ও তৈরী হ’য়ে নিয়েছিল। দরোজা বন্ধ। ভিতর থেকে আওয়াজ দিল… চ’লে আসুন মাশাই। আপনিও পোশাক পাল্টে নিন। ওরা ঘরের টেবিলে মোমো ভরা প্লেট, চাটনির বাটি আর চামচ রেখে বাইরে আসতেই… প্রিয়াকে বললাম… ও জঙ্গলসে এক ভারী আওয়াজ আয়া থা… আমার কথা থেমে গেল। সাগর সিঁড়ি দিয়ে নামছে আর বলছে… ও জংলী শ্যেরকা আওয়াজ। হো ভি সকতা ব্ল্যাক প্যান্থার। হাড় হিম করা সংলাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নীচে। প্রিয়ার দিকে তাকালাম। ও হাসছে। ঠোঁটের ফাঁকে চকচক করছে সাদা দাঁতের দু’টো সারি। চোখ দু’টো খুব ছোট ক’রে বলছে… ইধার তো বহোত জংলী জানবার হ্যায়। শ্যের হ্যায়, ব্ল্যাক প্যান্থার অর ভালু ভি হ্যায় অগল বগল মে। প্রিয়ার কথা শুনছি আর কান গরম হ’য়ে উঠছে। ঠান্ডাটাও কনকনিয়ে উঠছে পাঁজরের ফাঁকে…
ঘরে ঢুকে গেলাম। সোমনাথ ব’সে পড়েছে প্লেটের সামনে। পিছন থেকে প্রিয়া বলছে… রোটিকে সাথ ক্যা রাইশাক কা ভাজ্জি চলেগা আঙ্কল… এক সবজি তো বনাউঙ্গী জরুর… অর কুছ… মাথা নেড়ে সম্মতি জানাচ্ছে সোমনাথ, ওর মুখে গোটা দু’য়েক মোমো আনন্দে নাচছে তখন। খান তিরিশেক মোমো চাটনি সহযোগে বেশ দ্রুত শেষ হ’য়ে গেল। সোমনাথকে বললাম… চলো, বাইরে একটু ঘুরে আসি। পাহাড়ী বিড়ি পাওয়া দরকার। মোমোর স্বাদে সারা শরীর বেশ তাজা হ’য়ে উঠেছে, বলল… চলুন, ঘরে ব’সে ভাল্লাগবে না। আর ঐ যে, ঝর্ণাটা দেখার ব্যাপারেও কথা বলতে হবে সাগরের সাথে। আগামীকাল সকালেই যেতে হবে ওখানে।
বাইরে বেরুতে হবে। জ্যাকেটটা গলিয়ে নিলাম। নীচে নেমেই উঁকি দিলাম রান্নাঘরে। সাগর আটা মাখছে, প্রিয়া আলু কাটছে… আমাদের ভিতরে আহ্বান করছে প্রিয়া। সোমনাথ দরোজার ফাঁকে মাথা গলিয়ে বলল… বিড়ি মিলেগা ক্যা..? পাহাড়ী বিড়ি, ইধারকা… সাগর জানাল… থোরা সা নীচে যানা পড়েগা… দুকান মিলেগা। উঠোনটা পার হয়ে নেমে গেছে পথ। সোমনাথের মোবাইল টর্চ জ্ব’লে উঠলো। সন্তর্পণে নামছি… দু’পাশের ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝিঁর ডাক, সবুজ বুনো গন্ধ আর অন্ধকারের রোমাঞ্চ মিলেমিশে যাচ্ছে বুকের ভিতর। মনের ভিতর, আর সারা শরীর জুড়ে একটা নিস্তব্ধতা। নির্জনতাকে ছিঁড়ে কথা বলতে চাইছি না কেউ।
বাঁ হাতে রূপসী রঞ্জিতার ঘর। সোমনাথ হাঁক দিল, কিন্তু প্রত্যুত্তর পেলাম না। আরো নীচে নামছি… পাথুরে পথ, সেই যে ওঠার সময় টেন্ট ফেলা একটা ছোট্ট উঠোন পেয়েছিলাম, একটু আয়েশে ব’সে পড়েছিলাম… সেই উঠোনটায় নেমে এলাম। হাঁক দিলাম… কোই হ্যায়… ধ্বনি প্রতিধ্বনি ক্রমশঃ আবর্তিত হ’তে হ’তে ক্ষীণ হ’য়ে উঠতেই একটা ঘরের জানালা খুলে গেল। বললাম… ইধার কোই দুকান মিলেগা ক্যা? বিড়ি চাহিয়ে… মিলেগা..? জানালাটা খোলা, কাউকে দেখছি না সেই আয়ত ক্ষেত্রের আবছা আলোর ভিতরে। খানিক বিরতি। শব্দ ভেসে এলো শুধু… উধার যাইয়ে, মিলেগা। ব্যস্। জানালা বন্ধ হ’য়ে গেল। অন্ধকার আর ঠান্ডা দু’টোই জমিয়ে চেপে বসছে গ্রামটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। কিন্তু… কিধার যাউঙ্গা…
আসার সময় সাগর বলেছিল এই টেন্টের কাছেই একটা দোকান আছে। সোমনাথ টর্চের আলো ঘুরিয়ে চলেছে আশপাশে। উঠোনের ওই পিছনে একটা ঘর থেকে এক টুকরো আলো এসে পড়েছে খাদের কিনারায়। তারপর সে আলো মিলিয়ে গেছে কালো কালো পাতার ভিতরে। সে দিকেই বাড়িয়ে দিলাম অনুসন্ধান। এদিকটা ঘরের পিছন দিক। ঘুরে গেলাম এবড়ো খেবড়ো অন্ধকারে, সামনেটায় যাওয়া দরকার। সোমনাথ ডাক দিল… কোই হ্যায়? ঘরের দরজাটা সামান্য ফাঁক করাই ছিল। দেখছি একটি বছর কুড়ির মেয়ে টিমটিমে কুপি হাতে সেই ফাঁকটা বড় ক’রে লম্বা আলোর মত এসে দাঁড়াল। বললাম… ইধার কোই দুকান হ্যায়? বিড়ি মিলেগা? মেয়েটি হাসছে। দু’চোখের ভিতর জমাট কৌতূহল। বলছে… মিলেগা। অন্দর আইয়ে না… আপ তো প্রিয়াকে ঘর পর আয়া হ্যায়…
এই তো গোটা কয় ঘর এ গাঁয়ে। সবাই সবার খবর রাখে তাই। বসলাম কাঠের পিঁড়ে টেনে। মেয়েটির নাম সুস্মিতা রাই। রান্না করছে। উনুনের পাশে ব’সে কথা বলছি ওর সাথে। কড়াইতে মাংসের গন্ধ। বলছে… ইধার ভি দো আদমী আয়া থা। হামারি ঘর পে। এক লেড়কা… সৌরভ, অর এক লেড়কি। উনকে লিয়ে খানা পাকানা চল রহা হ্যায়। সৌরভ। ছেলেটির সাথে ঘন্টাখানেক আগেই কথা হচ্ছিল প্রিয়ার রান্নাঘরে। সোমনাথ বলছে… তুমারি হাসবেন্ড হ্যায় কাঁহা..? ভারি মিষ্টি হাসি সুস্মিতার। গালে টোল পড়েছে। বলছে… ও উপ্পর মে হ্যায়, সৌরভকা ঘরপে। দু’বান্ডিল পাহাড়ী বিড়ি নিয়ে চললাম সৌরভের ঘরের দিকে। সুস্মিতা আলো হাতে উঠোনটা পার ক’রে দিয়ে বলল… সৌরভকে সাথ মিলনে কে বাদ জরুর আইয়েগা ইধার। তাকালাম পাহাড়ী মেয়েটার দিকে। ওর গালে সেই আন্তরিক টোল পড়েছে। সারা মুখের উঁচু উঁচু অংশগুলোতে আলো পড়েছে। চকচক করছে ওর উচ্ছ্বাস আর কৌতূহল। বললাম… ঠিক ঠিক।
ক্রমশ