যখন বুঝতে শিখেছি, মনে রাখতে শিখেছি, সেই পাহাড়ে চড়বার প্রথম অভিজ্ঞতা আমি তোমাদের জানাচ্ছি। এইজন্য বললাম, জেনেছিলাম আমি যখন মায়ের কোলে তখন একবার বাবা- মায়ের সাথে দার্জিলিং- এ বেড়াতে এসেছিলাম, দেখতে গিয়েছিলাম টাইগারহিলের সানরাইজ। তবে তা শোনা কথা, আমার দেখা সেই প্রথম পাহাড়।
হিলকার্ট রোড। শিলিগুড়ি শহরের বুকচিরে সোজা উঠে গিয়েছে হিমালয়ের মাথায়। প্রবল পরাক্রমশালী সেই ব্রিটিশদের রাজত্ব। যারা আজ থেকে একশো বছর আগে লন্ডন শহরে টেমস নদীর তলদিয়ে টিউব রেলের লাইন পেতেছিল, তারা প্রকৃতিকে জয় করতেই ভালবাসে। মাথা নত করবে কেন? দূর্গম পাহাড়ে প্রথমে মানুষের সহজসাধ্য চলাচলের জন্য গোরুরগাড়ির জন্য এই রাস্তা পাহাড় আর জঙ্গল কেটে তৈরী হল। তারপর পৃথিবীর মানুষ কে অবাক করে দিয়ে সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে দিল রেলের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঘুম স্টেশন হয়ে উঠল পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম স্টেশন। সম্ভবতঃ এখন সে রেকর্ড নেই। বারেবারে দেখা হচ্ছে সর্পিল আকারের রাস্তা আর রেললাইনের।
রাস্তায় জিপ, মিনি ট্রাক ছুটছে আর রেললাইনে খেলনাট্রেন। কখনও রেললাইন ওপরে আর রাস্তা নিচে, আবার কখনও আমরা ট্রেনে বসে নিচে আর গাড়ি বাস ওপরে ছুটছে। সমতল থেকে পাহাড় দেখছিলাম। এখন দেখছি পাহাড় থেকে নিচের সমতল। ঘন জঙ্গল। বাবা বললেন- ঐ জঙ্গল হল মহানন্দা অভয়ারণ্য। জন্তু- জানোয়ারের বাস ওখানে। জানিস এই জঙ্গলে রয়ালবেঙ্গল টাইগারের ও দেখা পাওয়া গিয়েছে। আর দেখতে পাবি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এরপর একদিন তোদের ঐ জঙ্গলে বেড়াতে নিয়ে যাব। ঘরের কাছের এত সুন্দর একটি জঙ্গলের কথা কারও মনেই পড়ে না।
Common hill myna, Mahananda Wildlife Sanctuary, March’2021
ফটোগ্রাফ সৌজন্য: পাপুন ভট্টাচার্য্য, শিলিগুড়ি ( নেচার ফটোগ্রাফার)
আজ সকালের বৃষ্টি সমস্ত গাছের পাতা ধুইয়ে সবুজের নানারকম ভেদে আমার চোখে এমন ধারায় উজ্বল হয়ে উঠল যে সেই সবুজ এখনও আমি খুব মনে করতে পারি। অরণ্য সবুজ গাছপালার সবুজ রঙ মেখে পুরো প্রকৃতি সবুজ। তোমাদেরও নিশ্চয় খুব ভালো লাগে? ছোট্ট – ছোট্ট রেলস্টেশন ইঁট আর কাঠ দিয়ে কী সুন্দর দেখতে। শিলিগুড়ি জংশনের পর শুকনা রেল স্টেশন, তারপর চুনাভাট্টি ( বর্তমানে নেই ) পেরিয়ে আমরা এলাম রংটং। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝোরার জল পড়ছে। তাতে সূর্যের আলো পড়ে মুক্তোর মতন ঝিলিক মারছে। আমিও আনন্দে হাসছি। আমার জানালা ধরে দাঁড়ানো সেই চেয়ে- চেয়ে দেখা রূপকথার দেশে প্রবেশ করে।
এরপরেই নাকি শুরু হবে জিগজাগ। ট্রেন এগুবে আবার পিছিয়ে আসবে। ঐ যে বালিভর্তি টিন রেখেছিল তা থেকে বালি ছেটাবে রেলপথে, যাতে ট্রেন লাইন থেকে পিছলে না পড়ে। বেলচা করে তুলে এনে। এই যে জিগজাগ বা জেড আকারে রেল- লাইন পাতা, পরে আমাদের স্কুলের এক শিক্ষকের কাছে শুনেছিলাম মজার একটি গল্প। সে গল্পটি এখানে বলছি–
ইংরেজী ১৮৮০ সালের বা সেইসময়ের কথা। ব্রিটিশরা দার্জিলিং হিমালয়ান রেলপথের সেই অবিস্মরণীয় রেল- লাইন পেতে হিমালয়কে রেল মানচিত্রে এনে সারা পৃথিবীর কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাইছেন। একজন ইংরেজ চীফ- ইন্জিনীয়ার ঐ কাজে ব্যস্ত। কিন্তু পাহাড় কেটে- কেটে এগোতে গিয়ে রংটং- র পর খাড়াই পাহাড়ে রেল- লাইন পাততে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। কাজ এগোবে কী করে? গালে হাত দিয়ে ড্রয়িং টেবিলে বসে ভাবছেন। এমন সময় তার স্ত্রী ডিকশনারী ঘাঁটতে গিয়ে একটা ইংরেজী শব্দ উচ্চারণ করেছেন। জিগজাগ। ব্যাস লাফিয়ে উঠলেন সেই সুদক্ষ ইন্জিনীয়ার। এরপরে দ্রুত গতিতে এগোতে লাগলো হিমালয়ান রেলপথ তৈরীর কাজ। জেডের আকৃতিতে খাড়াই জায়গায় রেললাইন পেতে কাজ শুরু হল। তোমরা যখন এই টয়ট্রেনে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবে জিগজাগের মজা নেবে। কেন দুটো ইন্জিন জোড়া লাগান হয় এই ছোট্ট ট্রেনে।
(নীলকান্ত/নীলকণ্ঠ ,( Indian Roller ), মহানন্দা অভয়ারণ্য , মার্চ ‘২০২১)
ফটোগ্রাফ সৌজন্য: পাপুন ভট্টাচার্য্য, শিলিগুড়ি ( নেচার ফটোগ্রাফার)
আমরা জিগজাগের পথ পেরিয়ে চলেছি হিমালয়ের আরও ওপরে। অদ্ভূত রোমাঞ্চে ভরে উঠছে মন। সামনে এগিয়ে আসছে তিনধারিয়া। তখনও তিনধারিয়ায় রেলের প্রচন্ড কর্মকাণ্ড। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের সারি- সারি বাড়ি। ট্রেন কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ঢুকছে কু ঝিক- ঝিক করে তিনধারিয়া স্টেশনে।