ধারাবাহিক বড় গল্পে গৌতম বাড়ই (পর্ব – ১৪)

স্মৃতিকথার ঝিকিমিকিরা
“জল ঝরে জল ঝরে সারাদিন সারারাত-
অফুরান নামতায় বাদলের ধারাপাত।”
এই ধারাপাত সত্যি ছিল আমাদের শৈশব বাল্যকাল আর কৈশোরের মুখে। ১৫- ই জুন এর মধ্যে মনসুন অর্থাৎ দক্ষিণ- পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর কল্যাণে আমাদের পশ্চিমবাংলায় সরকারী ভাবে বর্ষাকাল শুরু। উত্তরবঙ্গে তার দিনসাতেক আগে। আকাশের সব মেঘগুলি তখন বর্ষার মেঘ? কত প্রশ্ন জাগে মনে।
(ফটো সৌজন্য: গৌতম বাড়ই)
আমাদের ছোটোবেলায় মৌসম নিয়ে এত কচকচি ছিল না। বৃষ্টি মানেই বৃষ্টি। সে নিম্নচাপ কী ঊর্দ্ধচাপ তা জানতাম না। তবে বৃষ্টি হত খুব ঝেঁপে, আমি উত্তরের সেই বৃষ্টির গল্প বলব তোমাদের। এক পক্ষকাল, তা প্রায় দিন পনের ধরে প্রায় বর্ষাতেই বৃষ্টি চলত। ভিজে জামাকাপড় স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। মা বলছে, আর তো মেলবার জায়গা নেই! স্কুল নেই, কী করে যাব? স্কুলের ইউনিফর্ম একজোড়া, তা’তো ভিজে গিয়ে একসা আর পড়বার জো নেই। ওদিকে প্রায় দিন রেনী-ডে চলছে। আমাদের ছোটোদের ঠিক এই সময়টাতে স্কুলে যেতে ইচ্ছে করত। বুঝতেই পারছ কেন? এন্তারসে ভিজব। নর্দমায় নেমে মাছ ধরব। বইয়ের ব্যাগ ভিজে গেলে মা আমাদের দু- ভাইয়ের ব্যাগ থেকে বই বের করে উনুনের পাশে শুকোতে দিত। উনুন? হ্যাঁ তখন তো এলপিজি গ্যাসের নাম- ই কেউ শুনিনি। কয়লার উনুন, গুল- ঘুঁটের রান্নার যুগ তখন। মায়েদের চোখে একটা পাওয়ার ফুল লেন্স বসত বয়সের অনেক আগেই।

(ফটো সৌজন্য: নেচার ফটোগ্রাফার পাপুন ভট্টাচার্য্য )
বর্ষার আগে এইসব রন্ধনের ইন্ধনগুলো যোগাড় করে রাখতে হত মায়েদেরই। মায়েরা যখন সামনে থাকে মায়েদের এত নানারকম কাজের ছবি চোখে পড়ে না, যখন বাবা- মায়ের ভালবাসায় তাদের প্রতিপালনে বড় হয়ে উঠি তখন ফেলে আসা সেইসব দিনের ছবি দেখতে পাই। সেইসময় হয়ত তারা বেশিরভাগই আমাদের থেকে অনেক অনেক দূরে।
(ফটো সৌজন্য: নেচার ফটোগ্রাফার পাপুন ভট্টাচার্য্য)
হচ্ছিল বৃষ্টির কথা, সেখানে ফিরে আসি। বড় হতে হতে অনেক কিছু হারালাম, হারালাম সেই ঘনঘোর মুষলধারের বৃষ্টি। বৃষ্টি যখন তখন তো একটু কাব্যকথা ছন্দকথাও থাকবে। কারণ বৃষ্টির তো ছন্দ আছে তার আকাশ থেকে পড়বার। সেই ছন্দ কী অপরূপ খেলত সারারাত বাড়ির টিনের চালের ওপর। যারা টিনের চালের পাকাবাড়ি বা কাঠের বাড়িতে থেকেছ তারা জানবে। তাহলে আবার ফিরি সুকুমার রায়ের সেই “শ্রাবণে ” কবিতায়।
“আকাশের মুখ ঢাকা, ধোঁয়ামাখা চারিধার,
পৃথিবীর ছাত পিটে ঝমাঝম বারিধার।
স্নান করে গাছপালা প্রাণখোলা বরষায়,
নদীনালা ঘোলাজল ভরে ওঠে ভরসায়।
উৎসব ঘনঘোর উন্মাদ শ্রাবণের
শেষ নাই শেষ নাই বরষার প্লাবনের।
জলেজলে জলময় দশদিক্ টলমল্,
অবিরাম একই গান, ঢালো জল ঢালো জল ।”

(ফটো সৌজন্য: গৌতম বাড়ই)