এ ছবিটি এ গল্পটি অনেক পুরানো। স্মৃতির ঝাঁপি থেকে ভেসে এলো । ক্যামেরার লেন্সে বলো কত আর ছবি ধরা থাকে? তাও তো সেই যুগটা ছিল এনালগের, ডিজিটাল স্বপ্নের বাইরে। একটা কালার ফটো ডেভেলপড করতে মোটামুটি সাত- সাতটা দিনের সময়। ছত্রিশটি অতি যত্নবান ফটোর বেশিরভাগই আছে এলবামের পাতায়। তারও আগে দেখেছি সাদা-কালো সিনেমার মতন Black & white স্টিল-ফটো। আমারও আছে কিছু নষ্টের ঘরে চলে যাওয়া সেইসব ফটো। এখন তো ডিজিটাল মুঠোফোনের লেন্সে কী ক্যামেরায় হাজার- হাজার ফটো, আর হাজারবার হারিয়ে যাওয়া। ঠিক গানের মতন, আগে একটা রেকর্ড বা লং-প্লেয়িং রেকর্ডের পূজাসংখ্যা গানের জন্য হা- পিত্যেশ করা অপেক্ষায় থাকতাম। আর এখন হাজার গায়ক, হাজার হাজার গান শুধু আঙুলের ছোঁয়ায় অথচ কেউ কী আর সেভাবে শুনি! সুলভ হলে যে কোন জিনিস মূল্যহীন হয়ে পড়ে সে আমাদের প্রজন্মের প্রত্যেকেই জানি। তোমরাও এ বাস্তবতা পরে অনুভব করবে। যুগ আর বিশেষ করে সময় বড় পরিবর্তনশীল।
কোথাও দূর থেকে তো ভেসে আসছে না, হুনহুনা! হুনহুনা! –অথচ পালকি আসছে একটু বুঝতে পারছি। কানে বাজছে পাল্কীর সেই বিখ্যাত গান– “পাল্কী চলে পাল্কী চলে। গগণ তলে আগুন জ্বলে।” কবি সত্যেন্দ্রনাথ আর গানের সুরকার সলিল চৌধুরী। সঙ্গে গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। একেই বলে মণিকাঞ্চন যোগ। তারপর ইতিহাস আর চিরায়ত সৃষ্টি। দূর থেকে প্রথমে দেখলাম চা- বাগানের মাঠঘাট ঠেলে কালো আবছা ছায়ার মতন পাল্কী আসছে। তবে নিঃশব্দে। খড়িবাড়ির সীমানা। দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমা। একপাশে নকশালবাড়ি, তার মাঝে সত্যি ঢেউ খেলে এগিয়ে আসছে পাল্কী, দেখে মনে হল চার বেহারা। কোনদিন পাল্কী স্বচক্ষে দেখতে পাব ভাবিনি। এক দাদা বলল— “ও তো আদিবাসীদের বিয়েতে যাচ্ছে। চা- বাগান আর সংলগ্ন এলাকায় আদিবাসী বা মদেশীয়রা কখনও দেখি পাল্কী ব্যবহার করে বিয়ে- শাদী উপলক্ষে এখনও। ” বিয়ে তার মানে তো ঝলমল পোষাক পড়া কেউ ভেতরেই থাকতে পারে। আমি দিলাম ছুট, যেখানে গিয়ে পাল্কী একদম সামনাসামনি দেখব। জীবনে দেখা কিছু মলিন আর দুঃখের স্মৃতিও বহন করে চলতে হয় জানো। আমারও পাল্কী দেখার পর তাই হল।
চারটে বেহারার সেই পাল্কী ছিল সম্ভবতঃ ঐ শতাব্দীর শেষ পাল্কী ওখানে। মরা জীর্ণসার দেহ। হাঁফাতে হাঁফাতে চলেছে। ভেতরের মহিলাটি যদি নতুন কনে- বৌ হয় তাহলে এত সস্তার জাঁকজমকহীন পোষাকে পাল্কীতে চেপে কোথায় চলেছে? এর উত্তর আজও পায়নি। বেহারা আর পালকির সওয়ারী তো একই রকম মনে হল। পার্থক্য কোথায়? মনে হয় এখনও ওটা বাস্তব না পরাবাস্তব? দিবা স্বপ্নের ঘোরে? সত্যি ওটা আমার বাস্তবে দেখা ছবি। আজও মনে পড়ে ঐ পাল্কীর কথা। তোমাদের কিশোর বয়সে ওরকম কল্পনার অনেক ঘোর থাকে। ঠিক কিনা? এই হল ভারতবর্ষ। অনেক বৈপরীত্য ছড়িয়ে আছে এখানে ওখানে এখনও।