• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক বড় গল্পে গৌতম বাড়ই (পর্ব – ২)

আমার ছোটোবেলার স্মৃতিকথা – ২

পরদিন ভোর বেলা। ভাদ্রের বৃষ্টি শেষে সেই স্মৃতিকথার অপূর্ব ভোর। এখনও মনে হয় রূপকথার সেই দিনগুলো যেন। আমরা চলেছি কু- ঝিক্ ঝিক্ টয়ট্রেনে। ইন্জিনের সামনে বসে রয়েছে মাথায় পাহাড়ি- টুপি একজন রেলকর্মী, পাশে বালির বালতি আর বেলচা রাখা। পরে বলছি কেন ঐ সাজ- সরঞ্জাম নিয়ে বসে থাকা। আমরা ট্রেনে উঠেছি শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন থেকে। টাউন স্টেশন পেরিয়ে আমরা প্রতিদিন স্কুলে যাই। যে স্টেশনের বয়স এখন দেড়শ বছর প্রায়। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন একটি রেলওয়ে স্টেশন। পুরোনো স্টেশন চত্বরের বিল্ডিং ছেড়ে আজ নতুন করে স্টেশন আর প্লাটফর্ম তৈরী হয়েছে। তবে ভীষণ খারাপ লাগে যখন চোখের সামনে এই ঐতিহ্যবাহী স্টেশনটি একটু- একটু করে ধ্বংস হতে দেখি। আমরা স্কুল থেকে ফেরার পথে অবাক হয়ে চেয়ে দেখতাম স্টেশনটি। এখানে বিপ্লবী এবং বীর বাঘাযতীন সাতজন ইংরেজ গোরা সৈন্যকে মেরে কুপোকাত করে দিয়েছিল একাই। কে আসেন নি তখন এখানে? কলকাতা তখন সারা ভারতবর্ষের রাজধানী আর গ্রীষ্মকালে বড়লাটের সভা বসত দার্জিলিং পাহাড়ে। দেশ- বিদেশের প্রখ্যাত লোকজন, দেশের নামীদামী মহাপুরুষগণ, নেতাজী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী, স্বামী বিবেকানন্দ সবার চরণস্পর্শে ধন্য এ স্টেশন চত্বর। আমাদের বৃদ্ধ মাষ্টারমশায়রা পুরোনো কথায় যখন ফিরে যেতেন বলতেন- যেদিন দেশবন্ধুর মরদেহ দার্জিলিং পাহাড়ে থেকে সমতলের শিলিগুড়িতে আনা হল সেদিনের সেই অখ্যাত গ্রামের সমস্ত পাড়ার লোকজন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এই স্টেশন চত্বরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায়। দার্জিলিং মেলে রাতে আবার কলকাতায় রওয়ানা হয়। সে ছিল বরণীয় লোকেদের স্মরণীয় যুগ। আজকের দেশের যেসব নেতাদের দেখি তারা এঁদের পায়ের ধূলিকণার যোগ্য নয়। দেশ আর দেশের লোকজনকে ভালবেসে নিজের কঠোর পরিশ্রমের বসতবাড়িও দান করে গিয়েছিলেন। আর আজ তার বিপরীত। তখন পাঁচ জোড়া টয়ট্রেন চলত পাহাড় আর সমতলে। এই স্টেশন থেকে আমার প্রথম পাহাড়ে চড়া শুরু, তাই তার কথাও তোমাদের জানাতে হয়। দেশটাকে জানাও তোমাদের কাছে জরুরী, অতীত না জানলে মূল্যায়ণ কী করে করবে? এবার ফিরে আসি শুরুর কথায়।

(শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের পুরোনো বিল্ডিং)
শিলিগুড়ি তখনও ব্যবসা বাণিজ্যের রমরমা শহর। তবে এখনকার মতন পুরো স্টেশনটিকে দোকানপাট বাজারে গ্রাস করেনি। কু- ঝিক্ ঝিক্ ছুটে চলেছে জগতজোড়া খ্যাতির সেই খেলনা ট্রেন। ” দার্জিলিং কো সানো রেল, ছুক ছুক কর দেইছো” — আমরা একটু- একটু শহরের ঘিঞ্জি কেটে এগোচ্ছি নর্থ জংশন বা শিলিগুড়ি জংশনের দিকে। আসলে হয়েছে কী শিলিগুড়ি শহরের গা ঘেঁষেই দক্ষিণ দিকে জলপাইগুড়ি জেলার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে পড়ে একটি বৃহৎ আকারের স্টেশনের উদ্বোধন হয়ে গিয়েছে। দেশভাগের পর এই অঞ্চলের সামরিক গুরুত্ব বুঝেই ভারত সরকার যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র করে গড়ে তুলতে চাইছে শিলিগুড়িকে। তো দক্ষিণে এক জংশন আর উত্তরে এক জংশন স্টেশন, ফলে শিলিগুড়ি জংশনের নাম লোকমুখে প্রচলিত হয়ে গেল নর্থ জংশন। আমাদের ছোটোবেলায় ঐ নামেই ডাকতাম আমরা। নর্থ জংশনে ঢুকতেই ট্রেনের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি সেই নীল পাহাড় আরও স্পষ্ট। আর সাদা সেই বরফ পাহাড় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বাবা বললেন– ঐ যে দেখছিস সাদা পাহাড়ের চূড়ো। জানিস তো ভালমতন- বরফে ঢাকা সাদা পাহাড় যেটি তা কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমরা কত ভাগ্যবান এই শহরের মানুষেরা বল, পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ চূড়ো ঘরে বসে দেখতে পাই।
আমার আর কিছুতেই ধৈর্য ধরছিল না, কখন ঐ পাহাড়ে ট্রেনে চেপে উঠব। তারপর আবার ট্রেন চলতে শুরু করল। শুকনার মহানন্দা অভয়ারণ্য সবে দেখা যাচ্ছে। শহর তখন তো শিলিগুড়ি জংশন ছাড়ালেই সবুজে সবুজে। এদিকে চা- বাগান। সবুজ সমুদ্রের মতন আর সামনে সবুজ অরণ্য। নীল পাহাড় ভ্যানিশ! সবুজের পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছি। আমার সেই রূপকথার দেশে। আমার সামনে এক অচেনা জগত সৃষ্টি হল সেদিন।
তারপর——-
আবার আগামী পর্বে। সামনের সপ্তাহে। পড়বে কিন্তু—-
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।