স্মৃতিকথারা সত্যি যেন ঝিকিমিকি করে জোনাকির মতন মনের ভেতর। যখন তখন। একলা নিরালায় বসলেই ভেতর থেকে যেন সেই ঝকমকি টের পাই।
সেই যে বলেছিলাম আগের পর্বের শেষে– তারপর ঘটল এক রহস্যময় যাদু, সেটাই বলছি। কার্শিয়াং রেল স্টেশনকে ডানহাতে রেখে আমরা দূরপিন দাড়া বা ঈগলস্ ক্রাগে উঠছি হেঁটে- হেঁটে। খাড়াই পথ। তবে মনের ভেতর অপার আনন্দ সেই পাহাড়ী পথ প্রথমবার ভাঙ্গবার। উঠছি। আর নিচের সমতলে চোখ রাখছি। এদিক- ওদিক তাকিয়ে দেখছি ধাপে ধাপে কত পাহাড়ি রঙ বেরঙের বাড়ি। নিচের সমতল যেন পরিষ্কার হয়ে উঠছে। পাহাড়চূড়ায় পৌঁছুতেই অবাক কান্ড– সূর্যের আলোয় ঝলমল চারিপাশ। কোথায় কুয়াশা! আলো ঝলমলে কার্শিয়াং। এই ঘন কুয়াশায় পাহাড়ী পথে হেঁটে গিয়ে হোটেলে খাওয়া আর এখন আলোয় আলোয় ভরা রাস্তাঘাট পাহাড় পর্বত খাদ সমতল সব একাকার। পাহাড়ের ঢালে চা- বাগান। দু- পাহাড়ের মাঝে গভীর নদীখাত। ধ্বসের চিহ্ন। ওপাশের পাহাড়ে মিরিক যাবার রাস্তা। প্রকৃতির এই মায়াবী যাদুতে মন ভরে গেল। পাহাড় যেন প্রকৃতির মায়াবী যাদুর ভাণ্ডার। ম্যাজিক বা যাদু আমার কাছে। তাই এখনও প্রকৃতির সেই রহস্য মনে আছে।
আমরা চারদিক তাকিয়ে দেখছি। পরে জেনেছিলাম এই ঈগলস্ ক্রাগের একটি বিচ্ছিরি নামও আছে। আমি সে নাম তোমাদের কাছে এখানে উচ্চারণ করব না। নিচের বাড়িঘর, খাপরাইলের সেনা ছাউনি, মহানন্দা এমন কি তিস্তার উপত্যকাও নজরে পড়ল। শুকনা, মহানন্দার ঘন জঙ্গলের মাথার ওপর আমরা। আঁকিবুকি শিলিগুড়ি শহরের বাড়ি। প্রকৃতির এই সুন্দরতার ছবি চির- জীবনের জন্যে মনে গেঁথে থাকল। সকাল থেকেই নিজে যেন আজ হারিয়ে যাচ্ছি প্রকৃতির এই গভীরে। দেখবে মিলিয়ে তোমাদের জীবনেও এমন কিছু দিন আছে যা সহজে এখনও ভুলে যাওনি। ওটাই স্মৃতিকথার ঝিকিমিকি। ওটাই স্মৃতির জোনাকি।
পাহাড়ের ওপর ভাই- বোনেদের ছোটাছুটি। কফি খাওয়া। বেঞ্চে বসা। এইভাবেই কেটে গেল সারাটা দিন। বিকেল হয়ে এলো। কার্শিয়াং বেড়িয়ে এবার ঘরে ফেরার পালা। ট্রেকারে চাপলাম। তখন পাহাড়ি পথে জিপ আর ট্রেকার ছিল অন্যতম যানবাহন। ওতেই ফিরব বাড়ি। বাবা বললেন– এবার আমরা নামব পাঙ্খাবাড়ি রোড ধরে। দেখবি মাত্র পঁচিশ মিনিটে আমরা শিলিগুড়ির সমতলে পৌঁছে যাব। এক- একটা পাহাড়ি বাঁকে আমরা নেমে আসছি অনেকটা নিচে। বুঝলাম বড় ভয়ংকর, বড় সুন্দর সেই পথ। হিলকার্ট রোডের মতন এ পাহাড়ী পথও ব্রিটিশদের তৈরী। গাড়ি নেমে আসছিল সেই চড়াই ভেঙ্গে। আলো- আলো ছায়া- ছায়া অন্ধকার নেমে আসছিল আমাদের চলার পথ ধরে।
পাহাড়ি জঙ্গলের কাঠের গন্ধ। পরে জেনেছিলাম ধূপীকাঠের গন্ধ। এ জঙ্গলে এই গাছ সহজলভ্য। ঝিঁঝিঁ আর নাম না জানা পাখির কিচিরমিচিরের শব্দ। আমরা তরতর করে নেমে আসছিলাম।