গল্পেরা জোনাকি তে দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

যেতে হয়

সম্পর্কের দীনতা, অসম্মান নিয়ে লড়াই যেন ছিল মানবের দিনলিপি। সম্পর্কের বন্ধনে থেকেও একাকীত্বের শূণ্যতা।ডানা মেলে উড়ে যাবার ঠিকানা খুঁজতো বিনিদ্র রাতের তারাদের সঙ্গী করে।তারারা সব জানতো ওর কষ্টের ইতিহাস ! লজ্জায় মানব বলতে পারতো না কাউকেওর কষ্টের কথা।কি বলবে সকলকে? প্রতিদিন নিজের স্ত্রী, ছেলের হাতে অসম্মানের কথা বলা যায় কাউকে? চেষ্টা করেছিল দু একবার । কিন্তু তারা সমাধানের উপায়ে না থেকে কোথায় যেন এক মজার পরিধি খুঁজেছিল।এক বন্ধু তো ওর অবর্তমানে বাড়িতে এসে ওর বলা কথাগুলো স্ত্রীকে বলে ফায়দা তুলে গেছে।এখন আর এতে রাগ হয় না।বুঝে গেছে সুদেষ্ণার কাছে শরীরের চাহিদাই যেন পবিত্র সবচেয়ে। কষ্টের পাথর চাপা থেকে থেকে ভালোবাসার সবুজ ঘাসের রঙ কবেই সাদা হয়ে গেছে। শুধু অপেক্ষায় ছিল কর্মজীবনের অবসরের।সব গুছিয়ে বুঝিয়ে বিদায়।গরুবাথানের মনজয়ের কাছে চলে যাবে। একটা ছোট আস্তানা করে রেখেছে এর মধ্যেই মনজয়ের সাহায্যে। সবুজের বুকেই ওর বন্ধন মুক্তির ঠিকানা হোক ! সর্বস্ব হারিয়ে মানবের কিনে দেওয়া ট্যাক্সি চালিয়ে মনজয়ও জীবনের যন্ত্রণা ভুলতে চায়।’মানব সাব ‘ওর দেবতা।দুভায়ে থেকে যাবে বাকি জীবনটা।পেনসন তো রইল।যা পাবে তাতে বাড়ির লোককে দিয়েও অনেকটাই থাকবে মানবের। চলে যাবে পাহাড়ের সহজ সরল জীবনযাত্রায়।ধীর স্থির নগাধিরাজ ওকেও যেন ডেকে চলেছে অহর্নিশ। বুকের ভেতর মুক্তির পাখিটা ডানা ঝাপটায় ওড়ার অপেক্ষায়।
স্ত্রী ছেলেকে ব্যাঙ্ক পোষ্ট অফিসের সব টাকা পয়সা বুঝিয়ে দেয় মানব। ওদের বলে, হঠাৎ করে ওর কিছু হয়ে গেলে কি হবে তখন? তোমরা বুঝে নাও।সকলেরই জানা থাক কোথায় কি রইল। ওদের চোখে সেদিন মানবের জন্য কোন কষ্ট ছিল না।লোভ চকচকে চোখের দিকে তাকিয়ে ঘেন্নায় সরে এসেছিল ও।প্রতি মাসে পেনসানের ও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে চলে যাবে,একথাও জানায় ও স্ত্রীকে।অতো টাকার লোভে একবারও ওদের মনে হয়নি কেন এমনকরে সব কিছু ব্যবস্থা করছে মানুষটা ! নাকি ওরাও এটা চেয়েছিল? বুকচাপা কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিল সেদিন।এতো দিনের একসাথে থাকার কোন মূল্যই নেই ওদের কাছে। আগেই অবশ্য বুঝেছিল মানব যে পরিবারে ও এখন একটা এটিএম মেশিনের মতো।টাকা দেওয়া ছাড়া আর যেন কোন অস্তিত্বই নেই ওর স্ত্রী ছেলের কাছে! শাওয়ারের ধারায় কান্নার জল ধুতে ধুতে সেদিন মনটাকে শক্ত করেছিল ও।বিদায় জানাতেই হবে।ও না থাকলেও এখন ওদের অসুবিধা হবে না। কর্তব্য তো সবই করলো।আর সমস্যা নিয়ে বাঁচা নয়।এ দিনের অপেক্ষাতেই তো ও তৈরি করছিল নিজেকে।বিদায় !
ভোরবেলা ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়ল মানব।এখন যাবে বর্ধমান।মনজয়ের জন্য সীতাভোগ মিহিদানা কিনে নিয়ে যাবে।তারপর রাতের ট্রেন ধরবে জলপাইগুড়ির। ছেলে বউ ঘুম থেকে উঠবে প্রায় নটা দশটা। আস্তে আস্তে ও বেড়িয়ে এলো রাস্তায়। বুকের পাঁজরে কান্না যেন ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে।পা যেন মাটির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। এগোতে চাইছে না।ওর তিলতিল কষ্টে বানানো সাম্রাজ্য ছেড়ে যেতে মন নাহি চায় !টেনে হিঁচড়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলল।বুঝে গেছে, সারাটা জীবন এক পন্ডশ্রমই বলা যায়।ওরই দোষ হয়তো।এসব ভেবে ‌ এখন আর কোন লাভও নেই। মুক্তির ঠিকানায় মহানিস্ক্রমণ যেন !
চলতে বড়ো লাগে ঈশ্বর, চলতে বড়ো লাগে।
অন্ধকার শুনশান রাস্তা। এতো ভোরে কেই বা বের হবে এই শীতের সময়। প্রাথমিক কষ্ট কাটিয়ে এখন অনেক হালকা লাগছে ওর।এ মূহুর্ত থেকে ওর আর পরিবার বলতে কেউ নেই ! শুধুই পদাতিক জীবন ! হঠাৎ পিছনে একটা আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকাতেই দেখল রাস্তার কুকুর ভুলো এগিয়ে আসছে ওর পিছুপিছু।ও কি কিছু বুঝতে পারলো? দাঁড়াতেই ছুটে এসে ওর পা ধরে টানতে লাগলো।যেন যেতে দিতে চায় না মানবকে।ভুলোর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।প্রতিদিন শুধু দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে দেওয়া কুকুরটাও ওর চলে যাওয়া বুঝতে পারছে।আর যাদের সবকিছু দিয়ে এলো এতোদিন নিজেকে বঞ্চিত করে কর্তব্য করার নামে তারা একটুও বুঝতে পারলো না। এখনো তারা ঘুমের ঘোরে।
ভুলোকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মানব।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।