T3 || স্তুতি || শারদ বিশেষ সংখ্যায় দেবব্রত ঘোষ মলয়

পূজোর সঞ্চালনা
সঞ্চালনা বিষয়টা বিবর্তিত হয়েছে গত তিন দশকে। আমি যখন প্রথম সঞ্চালনা করি সে সময়টা পেশাগতভাবে সঞ্চালকদের এতটা পরিসর ছিল না। একটা ঘটনার কথা মনে আছে। সময়টা আশির দশক। আমি যে পাড়ায় বড় হয়েছি সেই পাড়া কলকাতার খুব কাছে কিন্তু তখন অনেকটাই গ্রামীণ পরিবেশ। ধানক্ষেত না থাকলেও ঝোপঝাড়, শিয়ালের ডাক, পাখির কলকাকলি, শিয়াল মারা আদিবাসী, সাইকেল খেলা, মাঠে পর্দা টাঙিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শন, পাড়ায় পাড়ায় জলসা এইসব নিয়ে বেশ ছিল জায়গাটা।
আমার বাড়িটা একটা ছোট রাস্তার ধারে। বাড়ির সামনে ছিল গ্রিল দেওয়া বারান্দা। বারান্দার পর আমাদের ওই গলির রাস্তা, আর রাস্তার ওপারে একটি মাঠ, এখন যেখানে বাড়ি হয়ে গেছে। সে বছর মহালয়ার দিন ওই মাঠে আমাদের পাড়ার একমাত্র ক্লাব একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। আশেপাশের অঞ্চলগুলির বিভিন্ন ক্লাব তাতে অংশ নেয়। আর পরের দিন ওই মাঠেই আমরা কিছু উদ্যোগী ছেলে-মেয়ে আগমনী সংস্কৃতিক সন্ধ্যা পালন করি। আমি তখন কবিতা আবৃত্তি করি নিজের শখে। পাড়ার বড়রা আমাকে দায়িত্ব দেয় ওই দুটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করার জন্য। ফুটবল খেলার সঞ্চালনার কথা খুব একটা মনে না থাকলেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথাটা মনে আছে।
আমার খুব বই পড়ার নেশা ছিল। ফলে অনেক শব্দ আমি শিখে ফেলতাম। সেই সময় মঞ্চের সামনে দর্শk আসনে একদিকে পুরুষ এবং একদিকে মহিলাদের বসার ব্যবস্থা হয়েছিল। মাঝখান দিয়ে দড়ি বেঁধে যাতায়াতের রাস্তা করা ছিল। আমি মঞ্চ থেকে মাইকে অনুরোধ করেছিলাম – মাননীয় ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা মঞ্চের বাঁদিকে বসুন এবং আপনাদের “অর্ধেক আকাশ” যাঁরা উপস্থিত আছেন তাঁরা মঞ্চের ডান দিকে আসন সংগ্রহ করুন।
এই “অর্ধেক আকাশ” শব্দবন্ধটি তখনকার গ্রামীণ পরিবেশে বহু মানুষের মনে দাগ কেটেছিল। তারপর থেকে বোধ হয় আমি পাড়ার সমস্ত অনুষ্ঠানের অঘোষিত সঞ্চালক হয়ে উঠেছিলাম।
ধীরে ধীরে বাইরের পাড়া থেকেও কিছু অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করার ডাক আসতো। তবে সেগুলো মূলত রবীন্দ্রজয়ন্তী বা ছোটদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এর বাইরে কলকাতা ও বোম্বের (বর্তমান নাম মুম্বাই) বড় বড় শিল্পীদের নিয়ে কিছু বড় অনুষ্ঠান হতো যেগুলো সঞ্চালনা করতেন পেশাদার সঞ্চালকরা। তাঁদের সঞ্চালনার মাঝে মাঝে থাকত হাস্যকৌতুক। অনুষ্ঠানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সেই সঞ্চালনা আমার চোখে ছিল কিছুটা চড়া। এরপর আমি দু-একটা ডাক পেলেও কোনদিনই এই ধরনের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করার সাহস পাইনি। কারণ আমি দেখতাম যে জোকসগুলি উপস্থাপন করা হতো সেগুলির প্রধান লক্ষ্য ছিল মানুষকে হাসানো, গান-বাজনার মাঝে কিছুটা কমিক রিলিফ দেওয়া, সেখানে হালকা অশ্লীলতাও থাকতো। মঞ্চের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি মানুষকে হাসানো খুবই কঠিন কাজ। এই কাজ যাঁরা করতেন অথবা আজও করেন তাঁরা অবশ্যই নমস্য।
এরপর আমি আমাদের অঞ্চলের একটি গ্রন্থাগারের শতবর্ষ উপলক্ষে পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সঞ্চালনার সুযোগ পাই। সেই সময়ে ওই গ্রন্থাগারের পরিচালন সমিতিতে আমি সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে ছিলাম। সেই সময় কলকাতার মার্জিত ও রুচিশীল দর্শকের পছন্দের বড় বড় শিল্পীরা উপস্থিত ছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। আমার আজও মনে আছে একজন বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী এবং একজন খুবই জনপ্রিয় বাচিক শিল্পী তাঁদের অনুষ্ঠানের পর আমার সঞ্চালনার ভুয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
এরপর আত্মপ্রকাশ করে বিভিন্ন বেসরকারি দূরদর্শন এবং বেতার চ্যানেল। ফাংশনগুলিতেও পেশাদারিত্বের ছোঁয়া লাগে। বড় বড় অনুষ্ঠান সংগঠিত করার দায়িত্বে এসে যান বিভিন্ন পেশাদার মানুষ এবং তাঁদের সংগঠনরা। সেখানে মঞ্চে এবং চারপাশে বিজ্ঞাপন আসতে থাকে। আরও নানাভাব অনুষ্ঠান সংগঠনের আর্থিক দায়ভারটা অনেকটা লাঘব হয় উদ্যোক্তাদের। ফলত পেশাদারিত্বের স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই অনুষ্ঠানের মান উন্নত হতে থাকে। আর এই সময় থেকেই আত্মপ্রকাশ করতে থাকেন বিভিন্ন পেশাদার অনুষ্ঠান সঞ্চালকরা। এঁদের জন্য ধীরে ধীরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও তৈরি হয়।
এরপরও আমাদের মত অপেশাদার এবং অবৈতনিক সঞ্চালকদের অনেক অনুষ্ঠানেই যেতে হয় যেগুলি মূলত আন্তরিকতায় ভরপুর হলেও উদ্যোক্তাদের আর্থিক সামর্থ্যটা কম থাকে। এই ধরনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি শাল, পাঞ্জাবী বা স্মারকসহ বিভিন্ন উপহারও পেয়েছি।
একটি ছোটদের সংস্থার অনুষ্ঠানে আমি বিগত দশ বছর সঞ্চালনা করেছি। এরা একদম প্রথমেই আমাকে মঞ্চে সম্বর্ধনা দিয়ে তারপর অনুষ্ঠান শুরু করে। অন্য একটি সংগঠন যেটি মূলত তরুণীদের দ্বারা পরিচালিত, তারা উদ্বোধনী সংগীতের পরই রাখি পরিয়ে এবং চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সঞ্চালককে বরণ করে নিত। আমার কাছে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করার মূল আকর্ষণটা ছিল কিন্তু এই আন্তরিকতা ও ভালোবাসাগুলোই। সঞ্চালনার কাজটা বরাবরই কিছুটা পরিশ্রমের কারণ অনুষ্ঠানের সঞ্চালক উপস্থিত হন একদম শুরুতেই, আর শেষ করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়। অনেক সময়ই মাঝখানে কিছু খাবার সময়টুকুও পাওয়া যায় না। কিন্তু যখন অনুষ্ঠানের শেষে কিছু মানুষ এগিয়ে এসে হাত ধরে বলেন, দাদা আপনার সঞ্চালনা খুব ভালো লেগেছে। তখন মনে হয় পরিশ্রমটা সার্থক।
জৈবিক নিয়মে ক্রমশই আমাদের বয়স বাড়ছে। আর নতুন প্রজন্মের এগিয়ে আসাটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ছে। এই মুহূর্তে বহু নতুন ছেলে মেয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা শুনে আমি অনেক কিছু শিখি। বর্তমান প্রজন্ম অনেক বুদ্ধিমান এবং সংবেদনশীল। আমি বরাবরই সঞ্চালনায় মঞ্চ এবং চারপাশে উপস্থিত সমস্ত মানুষদের সম্মান দিতে এবং প্রাধান্য দিতে ভালবাসতাম। আমার মনে হয় মানুষকে ভালোবাসার চাইতে বড় অস্ত্র আর কিছু নেই। এ কারণে কিনা জানিনা, আমার অর্ধশতাধিক সঞ্চালনার অভিজ্ঞতায় আমি কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা প্রত্যক্ষ করিনি।
শেষ করার আগে নিজের সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে আমি আমার অনুজ সঞ্চালকদের জন্য দু একটি কথা বলতে চাই। প্রথমত মাইকে সঞ্চালনা করার সময় কখনোই চিৎকার করে কথা বলা উচিত নয়। ওই দায়িত্বটা নিয়ে নেয় সাউন্ড সিস্টেম নিজেই। আর সঞ্চালনা শান্ত কন্ঠে করলে শুনতে অনেক শ্রুতি মধুর লাগে। সঞ্চালনার মাঝে মাঝে উপযুক্ত জায়গা বুঝে দু একটি কবিতার লাইন কিম্বা ভালো উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কখনোই যেন সঞ্চালকের কথা অতিকথন না হয়ে যায়। মঞ্চে যে সব অতিথি উপস্থিত থাকেন সঞ্চালকের তাদের প্রতি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকা প্রয়োজন। অনেক সময় দর্শকদের চুপ করতে বলা অথবা কোন অভব্য আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয় সঞ্চালকদের, এই সময়গুলোতেও কিন্তু খুবই নম্রভাবে এবং যথাবিহিত সম্মান দিয়েই তাদের এই কথাগুলো বলতে হবে। যখন কোন শিল্পী সংগীত পরিবেশন করবেন সঞ্চালকের নিজের দায়িত্ব থাকা উচিত তার সঙ্গে যারা সঙ্গত করছেন তাদের নামগুলি জেনে নিয়ে যথাবিহিত সম্মানের সঙ্গে সেগুলি ঘোষণা করা। যে সংগঠন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা সেই সংগঠনের কেউ যেন নিজেকে উপেক্ষিত মনে না করেন এটা দেখাও সঞ্চালকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে আমি মনে করি। পাড়ার অনুষ্ঠান করার সময় আশেপাশের মানুষ তাদের বাড়ির বাচ্চাদের মঞ্চে ওঠানোর জন্য শেষ মুহূর্তে অনুরোধ করেন। অনুষ্ঠান সুচারুভাবে চালিয়ে নিয়ে গিয়েও এই ঘটনাগুলিকে সামলাতে শেখা সঞ্চালক এর অন্যতম অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়ে।
সবশেষে একটা কথা বলব, যে কোন কাজই যদি ভালোবেসে করা যায় সেই কাজটা অনেকটাই সার্থক ও নিখুঁত হয়ে ওঠে। আমি কখনোই ইচ্ছের বিরুদ্ধে সঞ্চালনা করিনি, কাজটা খুব ভালো লাগে বলেই আমি অনেক সময় দিয়ে এটা করেছি এমন অনেক সময়, যখন হয়তো আমার ব্যক্তিগত অন্যান্য কিছু কাজ ব্যাহত হয়েছে। তবুও আমার কোন অসুবিধা হয়নি কারণ আমি এই সঞ্চালনা করাটাকে অত্যন্ত ভালোবেসে করি। আজকের ছেলে মেয়েরা যারা সঞ্চালনায় আসতে চাও তাদের কাছে আমি একটাই কথা বলি, কাজটাকে খুব ভালোবেসে কর। আর কখনোই যেন সঞ্চালনার মাধ্যমে নিজেকে জাহির করা না হয়। সঞ্চালক নিজে কতটা পারদর্শী বা তার যোগ্যতা কতটা আছে এটা অন্যরা বলবেন, না বললেও কিছু ক্ষতি নেই, সঞ্চালক নিজে যেন এই কাজটি না করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমরা শিখি, তাই অবশ্যই জীবনের সর্বক্ষেত্রে যেমন তেমনই সঞ্চালনাতেও শেখার মনোভাব রাখতে হবে।
আসন্ন শারদীয়া উৎসবে পাড়ায় পাড়ায় মন্ডপে মন্ডপে বহু মানুষ সঞ্চালনা করবেন। আমিও। উৎসব যাতে শান্তিপূর্ণ, সার্থক, সফল ও সুন্দর হয়, এই দায়িত্ব কিন্তু সঞ্চালকদের উপর অনেকটাই বর্তায়। আমি নিশ্চিত, বর্তমান প্রজন্মের ধীশক্তি সম্পন্ন বুদ্ধিমান ছেলেমেয়েরা এই কাজটা খুব সুন্দর ও সফলভাবেই করবেন।