Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

শনিবারের হরেকরকম - এ অরূপ চট্টোপাধ্যায়

maro news
শনিবারের হরেকরকম - এ অরূপ চট্টোপাধ্যায়

নেপথ্যচারী

মহানায়ক উত্তমকুমার অভিনীত "অগ্নিশ্বর" ছায়াছবি টির কথা মনে পড়ে নিশ্চই সবার। কিংবদন্তি বাঙালি ঔপন্যাসিক বনফুল (ডা. বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) প্রণীত কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে ডা. অগ্নিশ্বর (উত্তমকুমার) একজন আহত বিপ্লবী-কে সাহায্য করেছিলেন পুলিশ-এর চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে । পরে মর্গ থেকে একটি মৃতদেহ আনিয়ে পুলিশ- কে বিভ্রান্ত করে বলেছিলেন - সেই সন্ত্রাসবাদী (ব্রিটিশ পুলিশের চোখে বিপ্লবীরা পরিগণিত ছিলেন সন্ত্রাসবাদী হিসাবেই) লোকটির মৃত্যু ঘটেছে । অতিচতুর পুলিশবাহিনী বুঝতেও পারলো না - যেই ডা. অগ্নিশ্বর শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ সাহেবের শিশুপুত্রকে সারা রাত চিকিৎসা করে জীবনসংশয় থেকে মুক্ত করে সুস্থ করতে পারেন , তিনি একজন বিপ্লবী কে সাহায্য করে নেপথ্য থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে পরোক্ষ ভূমিকাও নিতে পারেন ।

বাস্তবেও কিন্তু ছিলেন এমন অনেক নেপথ্যচারী নায়ক । অনেক জমিদার , অনেক জেলাশাসক , ব্রিটিশ সরকরের অনেক উচ্চপদস্থ কর্তা ব্যক্তিরা - যাদেরকে শ্বেতাঙ্গ সাহেব রা মনে করতেন ব্রিটিশ সরকারের অন্ধ অনুরাগী - প্রকৃতপক্ষে তারা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী দের আশ্রয়দাতা ও পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু বিপ্লবী দলের সেই সময়ের চিঠিপত্র-গুলি,, যে গুলি পরবর্তী কালে আবিষ্কৃত হয়েছে - সেগুলি কে একটু তদন্ত- মূলক ভাবে বিশ্লেষণ করলে পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে আরেক ভয়ঙ্কর চিত্রও কিন্তু বিধৃত হয় । নেপথ্যের মহান নায়ক- দের মত নেপথ্যের খলনায়করাও কিন্তু ছিলেন সেই যুগে।

ইতিহাসের পরিতাপের বিষয় এই যে সেই খলনায়করা মেঘের আড়ালে মেঘনাদ হয়েই রয়ে যান নি সবাই , তাদের কেউ কেউ সুপরিকল্পিত এবং সুপরিশীলিত একটি প্রহেলিকাময় ভাবমূর্তির নেপথ্যে মহান দেশপ্রেমিকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন স্বাধীন ভারতেও। স্বাধীন ভারতের সরকার শুধু নয় , ব্রিটিশ সরকারের থেকেও গোপনে তারা পেয়েছিলেন - প্রভূত পারিতোষিক অর্থমূল্য। এমন একটি ঘটনার কথাই আজ বলি । চট্টগ্রামের বিপ্লবী আন্দোলনের স্তম্ভ ছিলেন যারা - সেই লোকনাথ বল , অর্ধেন্দু দস্তিদার এবং আরো অনেকে ধরা পড়লেন। গোপন বিশ্বস্ত সূত্রে - সন্ধান পেয়ে একটি বাড়ি থেকে মাষ্টারদা সূর্য্য সেন কেও গ্রেপ্তার করলো পুলিশ, স্বল্প সময়-সাপেক্ষ একটি গুলি বিনিময়ের খন্ডযুদ্ধের পর । ব্রিটিশ কালকুঠুরি - তে মাষ্টারদা কে হত্যা করলো পুলিশ পৈশাচিক নৃশংসতার পরিচয় দিয়ে। সূর্য্য সেনের মৃতদেহকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে আইনানুগ মৃত্যুদণ্ডের মিথ্যা গল্প রটনা করাও হলো । কিন্তু মাষ্টারদা এমন একজন mastermind - যার অ্যাকশন প্ল্যান এত নিখুঁত - যা ব্রিটিশ পুলিশের সব চক্রান্তকে ব্যর্থ করেছিল ইতিপূর্বে একাধিকবার। কোনো ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া তো মাস্টারদার ধরা পড়ার কথা নয়। এই প্রশ্নটি ভাবিয়ে তুলেছিলো - ব্রিটিশ পুলিশের জাল ছিড়ে পালানো অবশিষ্ট একজন মাস্টারদার অনুগামীকে। উত্তরটিও সহজেই পেয়ে গেলেন সেই অজ্ঞাতপরিচয় পলাতক বিপ্লবী।

তিনি সুকৌশলে গোপন অনুসন্ধান করে জানলেন - দলের আর যে সকল সদস্য গোপনে কলকাতায় পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়ে রয়েছেন - তাদের কথা । তারা পরবর্তী পরিকল্পনা করছেন। আর যারা ধরা পড়েছেন - তাদের মধ্যে কাদের ফাঁসি হয়েছে , কাদের দ্বীপান্তর অথবা কাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ হয়েছে - সেই সব নামের তালিকা পাওয়া গেল সংবাদপত্র থেকেই। কিন্ত চট্টগ্রামের গোপন এক ডেরায় আশ্রিত সেই অজ্ঞাতপরিচয় বিপ্লবী আশ্চর্য হলেন - মাস্টারদার দলের তাদের সহযোদ্ধা নেত্র সেন,, তার তো কোনো সুলুক সন্ধান নেই । কোথায় সে ? না না , সে কোনো জেলখানায় নেই এমন কি তার কোনো দন্ডপ্রাপ্তির খবরও নেই ।

প্রবল কৌতূহলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও আরো অনুসন্ধান করে সেই অজ্ঞাতপরিচয় বিপ্লবী জানতে পারলেন - তাদের সেই সহযোদ্ধা নেত্র সেনের সাথে পুলিশএর গোপন আঁতাতের কথা । নেত্র সেন শুধু চট্টগ্রাম-এর বিপ্লবীদের সাথে বিশ্বাসঘতকতা করে পাওয়া বৃটিশ সরকারের পারিতোষিকেই তুষ্ট নয় । আরো ভয়ঙ্কর অর্থলিপ্সায় উন্মত্ত হয়ে সে পুলিশকে সন্ধান দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে - যুগান্তর দল , অনুশীলন সমিতির অন্যান্য বিপ্লবী সদস্যদের নাম , ঠিকানার।

সেই অজ্ঞাতপরিচয় বিপ্লবী কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন । চরম তঞ্চকতাময় বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন ব্রিটিশ পুলিশের দিকে । এই মর্মে তিনি পুলিশের আস্থা অর্জন করলেন - যে এই ব্রিটিশ বিরোধিতার বিষয়ে তিনি বীতশ্রদ্ধ । শুধু অর্থলিপ্সায় নয় - বহু বিপ্লবী কার্যকলাপ তার নিজের কাছেও নাকি ঘৃণ্য লাগছে বলেই তিনি ভারতের সামগ্রিক উন্নয়ন ও প্রগতির জন্যই ব্রিটিশ সরকারের স্থায়িত্ব চান । পুলিশের এই বিশ্বাস অর্জন করে তার আর আগের মত গোপন আস্তানায় আত্মগোপন করার তেমন প্রয়োজন থাকলো না । তিনি একদিন গেলেন নেত্র সেনের বাড়িতে দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের সময় । নেত্র সেন সানন্দে তাকে স্বাগতম জানিয়ে নিজের পাশেই বসতে বললেন - দুটি অন্নগ্রহনের জন্য । কিন্তু নিজেরই অন্নগ্রহন করা আর হলো না নেত্র সেনের। সেই অজ্ঞাতপরিচয় বিপ্লবী নিজের চাদরের ভিতর থেকে বের করলেন - এক কালী মন্দির থেকে চুরি করে আনা যুপকাষ্ঠের পশুবলির খড়গ। পূজ্যপাদ মাস্টারদার সাথে বিশ্বাসঘতকতার প্রতিশোধের প্রবল তাড়নায় - তীব্র জিঘাংসায় দেবীমন্দিরের সেই খড়্গ-এর এক আঘাতে নেত্র সেনের ছিন্ন মুণ্ড ফেললেন তারই ভাতের থালারর উপরে । এই ঘটনার আকস্মিক প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে পড়েছিলেন নেত্র সেনের বিবাহিতা স্ত্রী স্বয়ং। কিছুক্ষন বাকরুদ্ধ হয়ে থাকলেও - যখন সম্বিত ফিরে পেলেন সেই রমণী ,, এই হন্তারক বিপ্লবী তখন সেই সদ্য বিধবার পায়ের কাছে নিজের হাতের রক্তাক্ত খড়্গ টি রেখে তার কাছে শাস্তি প্রার্থনা করছেন । কিন্তু না , স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নেন নি সেইদিন সেই বিধবা স্ত্রী । নিজের সিঁথির সিঁদুরের চেয়েও অনেক বড়ো তার কাছে ছিল নিজের দেশের মুক্তি । আর তিনি এও জানতেন - দেশের মুক্তির এক ভয়ঙ্কর অন্তরায় তার সিঁথির সিঁদুর । স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতা তার অজানা ছিল না । তাই স্বামীর আততায়ী কে "ভ্রাতৃ" সম্বোধনে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে পালাবার পথ দেখিয়ে দিতেও ন্যুনতম কুণ্ঠাবোধ করেন নি সেই দেশপ্রেমী মহীয়সী । নেত্র সেন নিজে যদিও নেপথ্যচারী হয়ে থাকলেন না , সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলো তার হত্যার খবর । কিন্ত নেপথ্যে রয়ে গেলেন নেত্র সেনের বিধবা স্ত্রী এবং তার হন্তারক। কিন্ত নেপথ্যচারী প্রকৃত খলনায়ক কে কি চিনতে পারলো দেশের মানুষ ? বোধহয় না । তিনি রয়ে গেলেন সেই মিথ্যার প্রহেলিকা-ভরা ভাবমূর্তির অবগুণ্ঠনে ।এই প্রতিবেদক অসহায় তার নাম উল্লেখ করতে । কারণ , সরকারী নথি অনুযায়ী কোনো প্রমাণ তো নেই ই - থাকার কথাও নয়। কারণ , পৃষঠপোষক ব্রিটিশ পুলিশ তাদের এই প্রিয় পোষ্য তাবেদার প্রাণীটি কে আড়াল করে রেখেছিল । যদিও দেশ স্বাধীন হবার পর - এই তাবেদার দেশপ্রেমের অনন্য ভাবমূর্তির আড়ালে থেকে পেয়েছেন অজস্র ফলক , পদক , আমৃত্যু সরকারি ভাতা এবং বাম আমলের কিছু রাজনৈতিক প্রতিপত্তি । কিন্তু সতা ঘটনা জেনেছি আমারই সম্পর্কে এক দাদুর থেকে , যিনি ছিলেন মাস্টারদার দলের তদানীন্তন এক কিশোর সদস্য । বিশেষত , চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে বিপ্লবীদের অন্তর্দলীয় গুপ্তচরবৃত্তি- তে আমার এই দাদুর ভূমিকা ছিলো অনবদ্য। নেত্র সেনের চেয়ে অনেক "গভীর জলের মাছ" ছিলেন এই বৃটিশ তাবেদার। তার মৃত্যুর পরে তার স্মৃতির প্রতি অসীম শ্রদ্ধা নিবেদন করে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার উত্তর কলকাতার একটি উদ্যানের নামকরণ করেছেন তার নামে । যাই হোক , অনেক নিন্দা মন্দ করলাম । ইতিহাসের কেতাবী বুলি আমাদের মাথায় যা কিছু ঠুসে দিতে চেয়েছে - সেই বাঁধা ছকের বাইরে এত ব্যাতিক্রমী কথা বলার কি কোনো প্রয়োজন ছিলো আমার ? না বললেও তো চলত । সকল নেপথ্যচারীর চেয়ে বড় নেপথ্যের নায়ক বিশ্ব চরাচরের পালনকর্তা পরমেশ্বরের অবিদিত তো কোনো কিছুই নয়। অতএব এত নিন্দা আর কটু-কথা দিয়ে কলুষিত আমার এই খারাপ মুখটা একটু নাহয় শুদ্ধ করে নিই - তাঁর একটু স্তুতি, প্রশস্তিবাণী দিয়ে " জয় প্রভু গজানন"

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register