- 3
- 0
এবার 10/01 তারিখে আমরা যাচ্ছি ফ্রান্স। না মা, এবার উড়ে নয় আমরা যাব সুপার ফাস্ট ট্রেনে। ঘন্টায় সাড়ে তিনশো কিলোমিটার স্পীড। দেখবে এত স্মুদলি যাবে কিছু টের পাবে না। সত্যিই তাই ভেতরে বসে স্পীডের মহিমা কিছুই বুঝলাম না। মাত্র তিনঘন্টা কুড়ি মিনিটে আমরা পাড়ি দিলাম প্রায় সাড়ে পাঁচশ' কিলোমিটার পথ। নামলাম গারে ডু নর্ড (Gare du Nord) স্টেশনে।দর্শনীয় স্টেশন। বাইরে বেরিয়ে চোখ একে একে ছানাবড়া হতে লাগল। একি এখানে দেওয়ালে পানের পিক না গুটখা কিসের দাগ? ডাস্টবিন উপছে রাস্তায় কিছু ময়লা গড়াগড়ি খাচ্ছে। এটা কি ইউরোপ! ' মা কলকাতার সঙ্গে প্যারিসের অনেক মিল পাবে ' হঠাৎ ফুটপাথ থেকে কোনাকুনি টলমল করতে করতে একজন হেঁটে আসতে দেখে মিস্টার আমার হাত ধরে অন্যদিকে সরিয়ে নিলেন। এবারের ট্যুরে এই প্রথম একজন বেসামাল মানুষ দেখলাম। ভাবছেন দুঃখ হয়েছে, একেবারেই নয়। বেশ চেনা চেনা লাগছে। মা জলদি কর… আজ রাতে জম্পেশ করে ঘুমিয়ে নাও কাল সারাদিন টো টো করতে হবে কিন্তু তখন পা ব্যথা বলতে পারবে না। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হোটেলে রওনা দিলাম । মনটা খুশি হয়ে গেল আশেপাশে দুচারজন বাঙালিকে দেখে…. শুনেছি এখানে অনেক বাংলাদেশের লোক আছেন। পায়ে হেঁটেই এসে উঠলাম আমাদের হোটেলে। ছোট লিফ্ট তাই সওয়ার আমরা দুজন আর ছেলে উঠল ঐতিহ্যময় কাঠের সিঁড়ি বেয়ে। পরদিনের প্ল্যান আইফেল টাওয়ার। সকালবেলা ব্রেকফাস্ট করে যখন রাস্তায় বেরোলাম আমার চোখে ঘোর ঘোর!
প্যারিস এটা প্যারিস ! শিল্প সংস্কৃতির আর অনেক মিথের পীঠস্থান। অর্ধেক নগরী তুমি, অর্ধেক কল্পনা!...অনেক শিল্পীর স্বপ্নশহর। যাই হোক মোটে সময় নেই চটপট রওনা দিতে হবে। সামনেই সিঁড়ি নামছে মেট্রোস্টেশনের। ' জানো বাবা এখানকার মেট্রো সার্ভিস ইওরোপের সেকেন্ড বিজিয়েস্ট। রোজ নাকি পাঁচ লাখের বেশি লোককে সার্ভিস দেয়। ' ' বাবান এখানে যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্ট্রাইক চলছে ট্রান্সপোর্টের সমস্যা হবে না? ' ' দেখছো না মেট্রো বন্ধ বাস ট্রাম খুব কম পাবলিকট্রান্সপোর্টের ভরসা না করে আমি বরং ক্যাব বুক করছি। গাড়িতে যাওয়ার সময় দূর থেকে দেখলাম আইফেল টাওয়ার। আচমকা ধাক্কা লাগল মনে। এটা সেই পৃথিবীবিখ্যাত টাওয়ার? এটা দেখতে সারা পৃথিবীর লোক আসে! বাকি দুজনের মুখের দিকে তাকালাম..... নাঃ স্বপ্নভঙ্গের কোন আভাস তো নেই। গাড়ি ঘুরে গেল আর তারপর যখন দেখতে পেলাম তখন হঠাৎ দেখলাম আকাশের অনেকটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে আইফেল টাওয়ার। আরো কাছে গিয়ে একেবারে হতবাক! এতো একটা হিমালয়ান স্ট্রাকচার।
লাইনে দাঁড়িয়ে বাবাই বলল এত স্ট্রিক্ট চেকিং, এই যে ব্যুলেটপ্রুফ বেরিয়ার কিছুই ছিল না এখন গ্লোবাল আনরেস্টের জন্য ব্যাপার বদলে গেছে। নির্মাতা গুস্তাফো আইফেলের নামে এই টাওয়ার তৈরি হয়েছিল ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দে। ৩২০ মিটার বা ১০৫০ ফুট এর উচ্চতা। ১৮০৩৮ খন্ড লোহা দিয়ে তৈরী বিভিন্ন আকৃতির ছোট বড় কাঠামো জোড়া দিয়ে এই টাওয়ার তৈরী। লিফ্টে করে প্রথমে উঠলাম প্রথম তলায়। দূরবীন রয়েছে শহরটা দেখার। উচ্চতা ১৮৭ ফিট নিচে ছবির মত দেখাচ্ছে শহরটা। আমি তাড়াতাড়ি মোবাইল নিয়ে ভিডিও করে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে শুরু করলাম। কোন ভাল জিনিস একলা উপভোগ করলে আমার মন ভ'রে না। ওরা বাবা ছেলে অন্যদিকে কি করছে কে জানে। আমি বাপু এখন নড়ছি না। কি চমৎকার লাগছে চারদিকের দৃশ্য.... অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে নিজেকে চিমটি কেটে দেখি আকাশের গায়ে আটকে থাকা এই টাওয়ারে আমি! অনেকক্ষণ কেটে গেল তবু ওদের দেখা নেই... করছে কি! গিয়ে দেখি দিব্যি কফি খাচ্ছে দুজনে। বাঃ এর মধ্যে ফুডকর্ণারও আছে! ' তোমায় অনেকবার ফোন করেছি মা.... তারপর গিয়ে দেখলাম তুমি ভিডিও নিয়ে ব্যস্ত। নাও হ্যাভ য়োর সিপ আমরা নেক্সট ফ্লোর যাব। আবার লিফ্ট আর বিভিন্নভাষী মানুষের সঙ্গে পৌঁছে গেলাম ৩৭৭ফিট উচ্চতায় সেকেন্ড ফ্লোরে। চারদিকে ঘোরার চেষ্টা করছি কিন্তু তুমুল হাওয়ায় টুপি উড়ে যাওয়ার জোগাড়। তবু একটা নিরাপদ কোণ বেছে ভিডিও শুরু করলাম.... হাওয়ার দাপটে গলার স্বর ঘুড়ির মত উড়তে লাগল। অভিজ্ঞতা হচ্ছে বটে আমার! তবু টপ ফ্লোর এখন বন্ধ........ রিপেয়ারিং চলছে পরবর্তী সিজনের জন্যে। এটা প্রত্যেক বছরেই হয়। টাওয়ারের কঠিন শরীরে যত ইতিহাস যত উত্থান পতনের গল্প জমা হয়ে আছে তা আমাদের নাগালের বাইরেই থেকে গেল। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু টাওয়ারের শিরোপাও এখন আর নেই তবু ইতিহাস তাকে কোনদিন ভুলতে পারবে না। বাবাই বলল ভেবো না আইফেল টাওয়ার দেখা শেষ আরেকটা রূপ দেখবে অন্ধকার হলে। তবে এখন চল বেশ খিদে পেয়েছে। নিচে নেমে আশপাশটা একটু পাক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেখানে গেলাম সেখানে তখন অনেক ট্যুরিস্ট হাজির একটা দোকানের সামনে।
আরে এখানে কি খাবার? বাবাই দেখিস বিদেশি খাবার আমাদের... মা দ্যাখ ঐ বিশাল তাওয়ায় যেটা বানানো হচ্ছে ওটার নাম ক্রেপ ( Crepe ).আমি একে ওকে ঠেলে উঁকি মেরে দেখি দোসার মত একটা কি বানানো হচ্ছে তার ওপর চকলেট দিল তার ওপরে কলার টুকরো। তারপর আবার পাটিসাপটার মত মুড়িয়ে রোলের স্টাইলে কাগজ দিয়ে খানিকটা র্যাপ করে হাতে হাতে চালান করছে। ওরে বাবা এত চকোলেট। নাঃ চুপচাপ থাকাই ভাল! আমাদের টার্ন এল...... অসাধারণ! কি দারুণ স্বাদ। আমরা পাটিসাপটা নিয়ে কত গর্ব করি কিন্তু এটাও তো দিব্যি খেতে ' হাউ ইজ ইট কুকড? আই মিন আউট অফ হুইচ মেটিরিয়াল...... আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে বাবাাই বলল মা উনি তোমার একটা কথাও বুঝতে পারছেন না। তুমি তো লোকাল ল্যাঙ্গুয়েজ জান না। তুমি কি ভাবছ দেশের বাইরে সবাই ইংরেজি বলে। বোঝা, তোর মাকে ;আমি তো হেরে গেছি। প্লীজ তোমরা এখন এসব বন্ধ কর।
0 Comments.