Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

T3 || লক্ষ্মী পুজো || সংখ্যায় সুনৃতা রায় চৌধুরী

maro news
T3 || লক্ষ্মী পুজো || সংখ্যায় সুনৃতা রায় চৌধুরী

সেই মাধুরী

চার দিন ব্যাপী দুর্গোৎসবের রেশ কাটতে না কাটতেই তিনি আসেন বাংলার ঘরে ঘরে। কন্যা বিদায়ের বিষাদ সুরে আবার আনন্দের ছোঁয়া। মা লক্ষ্মীর আবাহনে মেতে ওঠে সকল বঙ্গবাসী। ধনের দেবী মা লক্ষ্মী। ধন, সম্পদ, আরোগ্য কামনায়, ক্ষুধার অন্নের সংস্থানের আশায় প্রতি গৃহে তাঁর সাদর আমন্ত্রণ। যক্ষপতি কুবেরও তো ধনের দেবতা। তাঁর অতল ভাণ্ডারে সঞ্চিত বিপুল বৈভব। কিন্তু মা লক্ষ্মীর দেওয়া ধন সম্পদের মধ্যে জড়িত থাকে শ্রী। সঞ্চিত হয়ে হয়ে তার ভার বাড়ে না, শ্রীটুকু ছড়িয়ে পড়ে সর্বজন কল্যাণে। কথিত আছে, লক্ষ্মী যখন আসেন, ধানের শীষে যেমন করে দুধ ভরে আসে, সেই রকম নিঃশব্দে তিনি আসেন। আর যদি কখনও ছেড়ে চলে যান, তখন 'গজভুক্ত কপিত্থবৎ' পড়ে থাকে সব। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভেতরে ভেতরে কতখানি নিঃস্ব হয়ে গেছেন তাঁর করুণা হতে বঞ্চিতজন। তাই লক্ষীর করুণাকে লালন করতে হয়। আচারে ব্যবহারে, দয়ায় দাক্ষিণ্যে, প্রাত্যহিক অভ্যাসে সেই কল্যাণখানি ধরে রাখতে বলা হয় আমাদের সেই শিশুকাল থেকেই। তাঁর ব্রতকথায় যে সব আচার আচরণের কথা বলা হয়েছে, বর্তমান জীবনধারায় তা পালন করা অসম্ভব। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত যে নির্দেশ, যথা পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা, অহঙ্কার না করা, অপচয় না করা, আলস্য কলহ মিথ্যা পরিহার করা, পরিশীলিত বাক্য, আচরণ, এগুলি তো সব অবস্থায় অনুসরণ করাই যায়। তাই তাঁর আবাহনে প্রতিটি ঘর হয় মার্জিত, পরিচ্ছন্ন। তাঁর আসার পথে শ্রীমণ্ডিত আল্পনা, তিনি ক্ষীরোদসম্ভবা, তাঁর আহ্বান শঙ্খরবে। ধাতব তীক্ষ্ণ শব্দ তাঁর অপছন্দ, তাই কাঁসর ঘণ্টার তীব্রতা নেই। তিনি শারদলক্ষ্মী, তাঁর আসনে তাই পদ্মফুল। তিনি ধান্যলক্ষ্মী, তাঁর পূজার উপাচারে নতুন ধানের শীষ। নানা জনে নানা ভাবে তাঁকে পূজা করেন। ধাতু বা মাটির মূর্তিতে, পটে আঁকা তাঁর প্রতিকৃতিতে, জলপূর্ণ ঘটেও তিনি পূজিতা হন। আমাদের বাড়ির রীতি ছিল গাছকৌটার পূজা। সেই কৌটায় রূপার টাকা, সিঁদুর, কড়ি, স্বর্ণালঙ্কার। আল্পনা দেওয়া কাঠের পিঁড়িতে শাড়ি, কড়ির মালা,সোনার হারে সাজিয়ে একটি বৌ পুতুলের আকার দিয়ে তাঁকে বসানো হতো। সেই পিঁড়িতেই ছোট ছোট কচু পাতায় সিঁদুর এবং ঘরকন্নায় ব্যবহৃত নানা মশলাপাতি। কাঁচা হলুদ, তিল, লবণ ইত্যাদি। একটি সশীর্ষ ধানগাছ, হলুদ গাছ, একটি ছোট মানকচুর চারা সঙ্গে নিয়ে সেই ঠাকরুণকে তুলসীতলায় পরিস্কার আল্পনা দেওয়া স্থানে সাতপাক ঘুরিয়ে শঙ্খ উলুধ্বনিতে বরণ করে এনে ঠাকুরঘরে অধিষ্ঠিত করা হতো পূজার আগের সন্ধ্যায়। কলাগাছের খোলা দিয়ে তৈরি হতো অত্যন্ত সুষমামণ্ডিত ধান চালের মরাই। তাতে ধান এবং আতপ চাল ভরা হতো। সিঁদুরের ফোঁটায় সাজানো সোনার মতো ঝকঝকে পিতলের জলপূর্ণ ঘটে আম্রপল্লব, ফল, ফুল। পূজার নৈবেদ্যে থাকতো নারকেল, তিলের নাড়ু, চিড়ের, খইয়ের মোয়া, নানারকম ফল, বিশেষ করে তালের ফোঁপল, পান সুপারি ইত্যাদি। সারা বাড়িতে লক্ষ্মীর পা, পূজার জায়গায় পদ্মফুল, পদ্মলতা, শিউলি ফুল, ধানের শীষ, ধানের মরাই, এমনকি বাহন পেচকটির প্রতিচ্ছবি লাল মেঝেতে সাদা ধবধবে চালের গুঁড়ির শুভ্রতায় আল্পনায় ফুটে উঠতো। বড়ো সুন্দর সেই সন্ধ্যা। আকাশে চাঁদের আলোয় সোনা ঝরছে, ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনি, চরাচরময় কেবল শ্রী। ধূপের গন্ধ, বাগান থেকে ভেসে আসছে সদ্য ফোটা শিউলির সুবাস থেকে থেকে রান্নাঘরে ভোগের খিচুড়ির সুবাসও তার সঙ্গে মিশেছে। প্রসাদ নিতে কতজন চলে আসতেন চেনা অচেনা অল্পচেনা! পরিপূর্ণ মনে তাঁরা ফিরে যেতেন। পরের দিন ছোট ছোট পাত্র হাতে কচি কচি শীর্ণ হাত বাড়িয়ে প্রসাদ নিতে আসতো পাশের বস্তির শিশুগুলো। তারাও ফিরতো পূর্ণ পাত্রে। ঐশ্বর্য নয়, বৈভব নয়, সেই শিল্প এবং শ্রী টুকুই আমাদের সম্বল। আজ কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় মায়ের কাছে এই প্রার্থনা, তাঁর পূজা যে যার সঙ্গতি অনুসারে করুক , হয়তো অনেক আড়ম্বরে, বহুল উপাচারে, কিন্তু আশেপাশে কেউ যেন অভুক্ত না থাকে। তিনি শ্রী রূপে, দয়া রূপে অন্তরে অধিষ্ঠান করুন। "মর্ত কাছে স্বর্গ যা চায়, সেই মাধুরী" তো করুণা, দয়া এবং শ্রী-এর মধ্যেই নিহিত।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register