Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

T3 || আমার উমা || 26য় প্রদীপ গুপ্ত

maro news
T3 || আমার উমা || 26য় প্রদীপ গুপ্ত

অকাল বোধন

অখন্ড সময়কে খন্ডিত করে মেয়েটি বেরিয়ে এলো কুমোরটুলির আটচালার ঘর থেকে। শিল্পী তখন আটচালার অন্যান্য মেয়েদের শাড়িকাপড়, গয়না পড়াতে ব্যাস্ত। মেয়েটির শরীরের মুখ থেকে গলা পর্যন্ত বাসন্তী রঙে রাঙানো, দীর্ঘ আয়তাকার দুটো আঁখি , ঘন পল্লবমন্ডিত আঁখিপাতা, ভ্রুলতা, ঠোঁট, কর্ণলতিকা, আর গালের দুপাশ বেয়ে লতিয়ে নামা হেয়ার লকস, টোল খাওয়া চিবুকের মাঝে নিঁখুতভাবে একটি ঘোর বাদামী রঙের তিল বসানো। মেয়েটির নিরাবসনা শরীরের দশবাহুর বাহুমধ্য থেকে নখের ডগা পর্যন্ত আর পায়ের পাতা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত রঙের কাজ শেষ করে রেখেছেন মৃৎশিল্পী। অন্য মেয়েদের দিকে দেখে, তাদের অঙ্গসজ্জা, অলঙ্কারবহুল শরীর, পড়নে দামী বেনারসি আর দশহাতে আয়ুধের তীব্র ঝলকানি দেখে আমাদের মেয়েটির গভীর অভিমান হলো। মেয়েটি বুঝলো অন্য মেয়েদের বাপের বাড়িতে যাওয়ার সময় এসে গেছে। অথচ তার বাপের বাড়ির ঠিকানার খবর নিয়ে এখনও কেউ শিল্পীর আটচালায় এসে পৌঁছোয় নি। মেয়েটি সিংহের পিঠ আর অসুরের কাঁধের থেকে সন্তর্পণে নেমে এলো। কেউ লক্ষ্য করলেন না। বসনভূষণহীন মেয়েটি এগিয়ে চললো গঙ্গার ধার ধরে। হঠাৎ একদল পুরুষমানুষ তাকে দেখে ধাওয়া করলো। ওদের মুখের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কামের লালারস। আমাদের বসনহীনা মেয়েটির শরীর জুড়ে ভয় নামলো। মেয়েটি ত্রাসে দৌড়োতে শুরু করলো। তার দৌড় থামলো একটা বিচ্ছিরি গলিতে এসে। সেখানে ক্ষয়া ক্ষয়া শরীরের মেয়েরা সস্তা রঙের চটকমাখা রঙ শরীরে মেখে খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের মেয়েটি কিছু বুঝলো, কিছু বুঝলো না। অবুঝ মেয়েটির কব্জিতে কার একজনের হাত এসে পড়লো। একজন ভারী গতরের মহিলা মুখের ভেতর জমে থাকা পানের পিক ফেলে তাকে বলে উঠলো -- বাঁচতে চাস? উত্তরের অপেক্ষা না করেই ওর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে ঢোকালো একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে। -- এখানে বোস, আমি শাড়ি নিয়ে আসি। পাশের ঘরে একটা চটুল গানের সুর ভেসে আসছে সাথে কাঁচের গেলাসের টুংটাং আর কিছু ইতরমার্কা শব্দ। মেয়েটি ফের কিছু বুঝলো কিছু বুঝলো না। তবে এটা বুঝলো এ জায়গাটাও তার পক্ষে নিরাপদ নয়। মেয়েটি নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো সেই ঘর থেকে। বেরোনোর সময় হাতের সামনে একটা পুরোনো রঙ ওঠা শাড়ি টেনে নিয়ে মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে। অর্ধনগ্না মেয়েটি ট্রেনের কামরায় চেপে এসে নামলো দিকশূন্যপুরে। সেখানে সারাটা মাঠ জুড়ে ফুটে আছে কাশফুল। নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘের ভেলা। ছোট্ট একটা নদী বয়ে চলেছে একেবেঁকে। কোথেকে একজন বৃদ্ধ আর একজন বৃদ্ধা ঠাহর করলেন আমাদের মেয়েটিকে। তাদের হাতে ধরা অস্ফুট কমল কোরক। এগিয়ে এলেন আমাদের মেয়েটির দিকে। -- তুমি কাদের ঘরের কন্যে গো মেয়ে? মেয়েটির মুখে কোনোও উত্তর নেই। মাথা নীচু করে বসে আছে ভুঁয়ে। বৃদ্ধ মানুষটি কি বুঝলেন কে জানে, এরকম ভূবনমোহিনী রূপ, কিন্তু এতো মলিন বসনে লজ্জা ঢেকে বসে আছে! তিনি তার হাতে ধরা পদ্মফুলের কুঁড়িগুলো মেয়েটির পায়ের কাছে রাখলেন। সেই মূহুর্তে বেজে উঠলো শঙ্খ, দিগবালিকারা উলুধ্বনি দিয়ে উঠলেন। বৃদ্ধা ভুমিতে আলুলায়িত হলেন, বৃদ্ধের মেঘমন্দ্রিত কন্ঠস্বরে ধ্বনিত হলো -- যা দেবী সর্বভূতেষু কমলরূপেণ সংস্থিতা... নবারুণের আলোয় রাঙা সাতরঙা বেনারসিতে মা বসনাবৃত হলেন। পাখিরা ঠোঁটে করে নিয়ে এলো ফলাদি, প্রজাপতি ডানায় ভেসে এলো পুষ্পাদি, বৃদ্ধবৃদ্ধা মাতৃ পুজোর আয়োজনে মেতে উঠলেন। আমাদের মেয়েটি তার বাপের ঘরের ঠিকানা খুঁজে পেলো। ইতিমধ্যে তিন দিন তিন রাত পূর্ণ হয়েছে। বৃদ্ধ তাঁর অশক্ত শরীরে আঁকড়ে ধরে আছেন আমাদের সেই মেয়েটির চরণকমল। আজকের রাত পোয়ালেই বিদায় দিতে হবে তাদের মানসকন্যাকে। বৃদ্ধার চোখের জলে নদীর বুক স্ফীত হচ্ছে, হাহাকারে শুকিয়ে যাচ্ছে আদিগন্ত কাশফুলের গুচ্ছ। দীর্ঘশ্বাসে থমকে দাঁড়িয়েছে বাতাস। ভোরের আলোয় ডানা ভাসিয়ে এসে হাজির হলো নীলকন্ঠ পাখি। কাশের হিল্লোলে বাজছে বিদায়ের সুর। মাটিতে আলুলায়িত বৃদ্ধা হাহাকার করে চলেছেন --- কেন এলি মা, এই দুদিনের মায়ায় কেন বাঁধলি আমাদের মায়ার বাঁধনে। আমাদের মেয়েটি ওদের কাঁধ ধরে তুলে ধরলেন। --- ফের আসবো বলেই তো যাওয়া গো মা। ধীরেধীরে নদীর জল উঠে এলো তীরে। মেয়েটির গোড়ালি সিক্ত হলো। মেয়েটির মৃণ্ময়ী শরীর বিলীন হলো নদীর অশ্রুসিক্ত কালস্রোতে। শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা শুধু আলো -- আঁধারে, কাঁদা -- হাসা শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুঁয়ে যাওয়া শুধু চলে যেতে যেতে কেঁদে চাওয়া শুধু নব দুরাশায়, আগে চলে যায় পিছে ফেলে যায় মিছে আশা।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register