Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

T3 || আমার উমা || 26য় মীনা সাহা

maro news
T3 || আমার উমা || 26য় মীনা সাহা

বিজয়া

উমা এবার উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে জুয়োলজি অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে । পাশাপাশি নিটের অনলাইন কোচিং ক্লাসও জয়েন করেছে। রেজাল্টও বেশ ভাল। ভবিষ্যতে নিশ্চয় একটা চাকরি-বাকরী পেয়ে যাবে। নতুন কলেজ , অনলাইন ক্লাস - সব মিলিয়ে বেশ ভালই আছে উমা।এরই মধ্যে নভেম্বরে মামার মেয়ে গোপা দিদির বিয়ের ডেট ঠিক হয়েছে।উমার তো আনন্দের অন্ত নেই। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তো কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি । এবার বেশ মজা, মামার বাড়িতে গিয়ে খুব আনন্দ করতে পারবে। দিদির বিয়ে বলে কথা । কত সাজগোজ – হাসি – ঠাট্টা - খাওয়া- দাওয়া...। আনন্দ আর আনন্দ । দিদির বিয়েতে যাবে জন্য উমা বেশ কয়েকটা দামি ড্রেস কিনেছে, মায়ের কাছে আবদার করেছে দিদির বিয়ের দিন সে শাড়ি পড়বে । দেখতে দেখতে বিয়ে দিন এসে গেল ।উমা মায়ের সাথে দু-চার দিন আগেই এসেছে মামার বাড়ি কলকাতায়। মফঃস্বল শহরে মানুষ উমা , তাই কলকাতা মহানগরী তার খুব একটা পছন্দ নয় । এত ঘিঞ্জি , এত যানবাহন , এত লোকজন , এত কোলাহল... । উমা ভাবতেই পারে না কি ভাবে সুউচ্চ বহুতল গুলোতে মানুষ বাস করে । কলকাতার মানুষজন বোধহয় এভাবেই অভ্যস্ত , তাই তাদের কোন অসুবিধায় লাগে না । বিয়ের দিন সকাল থেকেই নানা রিচুয়ালস নিয়ে ব্যস্ত সকলে । উমা তো সবসময় দিদির সাথে সাথে থাকছে আর বিয়ের নানা রকম নিয়মকানুন বেশ আনন্দের সাথে উপভোগ করছে । যথা সময়ে বিয়ে থা মিটে গেল । গোপার শশুর বাড়ির এক আত্মীয়ের ছেলের বিয়ের জন্য গোপার বোন উমাকে তাদের ভীষন পছন্দ হয় । গোপাকে পাত্রপক্ষ এই সম্বন্ধের কথা বলতেই সে পিসি পিশেমসায়কে ফোনে সব কথা জানায় ।পাত্রের বিবরণ শুনে রতনবাবুরও বেশ পছন্দ হয়ে যায় ।মেয়ের বয়স অল্প তবুও এমন সরকারি ইঞ্জিনিয়ার পাত্র হাতছাড়া করতে তার মন চায়নি। এখন বিয়ে না দিলেও যদি বিয়ের কথাটা এগিয়ে রাখতে পারেন ভেবে পাত্র পক্ষের প্রস্তাবে সারা দেন তিনি। কিন্তু দেখাশুনার পরে দুইপক্ষেরই পছন্দ হওয়াতে হঠকারী ভাবে বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল ।যদিও রতনবাবু বার বার করে পাত্রপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছিলেন মেয়ের পড়াশুনা শেষ হলে তারপর বিয়ে দেবেন ।কিন্তু পাত্রের বাড়ি থেকে উমার সবরকম স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার দেওয়াতে রতনবাবু বিয়েতে আর অমত করেন নি । সাত তাড়াতাড়ি উমার বিয়ে হয়ে গেল। এত অল্প বয়সে উমার বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা যে সত্যি একদমই উচিত হয়নি তা এখন নিজেই হাড়ে হাড়ে টের পারছেন রতনবাবু । বিয়ে ঠিক করার সময় ছেলের বাড়ির লোকজন খুব আগ্রহ নিয়েই বলেছিল একমাত্র ছেলের বউকে তারা মাথায় করে রাখবেন। কিন্তু বিয়ের কমাস যেতে না যেতেই সব আলোর মত পরিষ্কার। রতনবাবু এখন বেশ বুঝতে পারছেন কেমন বাড়িতে সে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পর থেকেই কারণে-অকারণে নানা অশান্তি লেগেই রয়েছে। রতনবাবু এখন মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছেন। কি করবেন তিনি এখন? মেয়েটাকে তো নিজে হাতে করেই জলে ফেলে দিয়েছেন।পাত্র এত ভাল চাকরি করে... ছোট সংসার কোন ঝুরঝামেলা নেই।আর সব সময় তো এমন সুপাত্রের খোঁজও মেলে না । তাই অন্য কোন ভাবনা-চিন্তা না করে একপ্রকার জোর করেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। এখন আর মেয়েটার জীবনে কোন স্বাধীনতা নেই, একপ্রকার কয়েদির জীবন কাটাচ্ছে উমা। সারাদিন রান্নাবান্না-ঘরের কাজ মুখ বুজে করে চলে, আর চুন থেকে পান খসলেই তার খাওয়া বন্ধ। উমার হাসব্যান্ডের তো নিজস্বতা বলতে কিছুই নেই, বাবা-মায়ের তালে তাল মেলায় ।চোখের সামনে উমাকে প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হতে দেখেও তার কোন বিকার নেই । উমার এই বন্দী জীবন আর ভালো লাগে না। জীবনের কোন সাধই আর পূরন হওয়ার নয়। শহুরে ফ্লাটের জীবন যেন আস্ত কয়েদখানা।ফ্লাটের জানালা দিয়ে একচিলতে আকাশ দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উমা। কত স্বপ্ন ছিল তার মনে... সে নিজের পায়ে দাঁড়াবে..চাকরি করবে। কিন্ত এখন কি জীবন সে কাটাচ্ছে...। মধ্যবিত্ত বাবা মায়েরা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও কেন যে ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ চিন্তা বাদ দিয়ে বিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হতে চায় কে জানে? উমা তো তারই শিকার। সামনে পূজা আসছে।মা বাবার কাছে যেতে পারবে কি না উমা নিজেও তা জানে না।এক এক করে ষষ্টি...সপ্তমী...অষ্টমী গেল। উমা এখনও ঘরবন্দী । নবমীর দিন উমা রান্না করছে পোলাও আর খাসির মাংস। শাশুড়িমায়ের বেশ কয়েকজন আত্মীয় আজ তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত । রান্নার পরিমানও বেশ অনেকটাই ।অতটুকু মেয়ে এত কাজ একাহাতে করতে হিমশিম খেয়ে যায় ।কিন্তু কোন উপাই নেই , তাকে করতেই হবে । পুজোর কটা দিন উমার খুব মনে পড়ছে তার বাবা মায়ের কথা ,বাড়িতে স্বাধীন ভাবে জীবন কাটানোর কথা, কতনা মধুর স্মৃতিময় দিনগুলির কথা।পুজোর কদিন জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া হত। নবমীর দিন তো কথায় নেই।খুব সকালে উমাকে নিয়ে রতনবাবু বেরিয়ে পড়তেন বাজারের ব্যাগ নিয়ে।প্রথমেই কিনতেন কচিপাঠার মাংস সাথে উমার পছন্দের মাছ গলদা চিংড়ি , ডিম ভর্তি ইলিশ আর পমফ্রেট মাছ। সামান্য চাকুরীজীবী রতন বাবুর পকেটে বেশ টান পড়ত , কিন্তু একমাত্র মেয়ে ভালোবাসে বলে কথা ।আজ যেন উমার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা বেশি বেশি করে মনে পড়ে যাচ্ছে।কষা মাংসের বাটি নিয়ে বাবার সাথে কত খুনসুটি চলত...। ওদিকে রতনবাবু মেয়ে-জামাই আসতে পারে ভেবে কিছুটা খাসির মাংস আর ইলিশ মাছ এনে রাখলেন। মনমেজাজ ভাল নেই তবু উমার মা সেগুলো রান্নার জন্য গোছগাছ করতে লাগল যদি ওরা আসে...। মাংস রান্না করতে গিয়ে আজ মেয়েটার কথা খুব মনে পড়ছে কৃষ্ণা দেবীর। বার বার অন্যমনস্ক হয়ে পড়াতে মাংস গেল পুড়ে। পোড়া মাংসের গন্ধ পেয়ে ঘর থেকে ছুটে আসেন রতনবাবু ।গ্যাস বন্ধ করে স্ত্রী কৃষ্ণকে ডাকতে থাকেন, “কোথায় তুমি ? এদিকে সব পুড়ে গেল তো ?” রতনবাবুর গলা পেয়ে ছুটে আসে কৃষ্ণা, “কি হয়েছে ?” –“দেখছো না মাংসের পোড়া গন্ধ বের হচ্ছে? ঘ্রাণ শক্তি কি হারিয়েছ?” এদিকে উমা মাংস কষাতে কষাতে ভুলেই গেল সে শশুর বাড়িতে, রয়েছে । মনের ভুলে কষা মাংসে জল দেওয়ার আগে এক টুকরো কষা মাংস মুখে পুড়ে দেয়। এঘটনা শাশুড়ির চোখে পড়তেই একেবারে তুলকালাম কান্ড। শাশুড়ি মা ছুটে গিয়ে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা সপাটে চেপে ধরে উমার মুখের ডান গালে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে উমা...। লজ্জায় অপমানে এই দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে উমা গায়ে কেরোসিন ঢেলে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিমেষের মধ্যে ফ্লাটের জানালা দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হতে থাকে । ফ্লাটের অন্য আবাসিকরা তা দেখতে পেয়ে সকলে ছুটে আসে। বাথরুমের দরজা ভেঙে উমাকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওরাই খবর দেয় উমার বাড়িতে ।ছুটে আসেন রতনবাবু আর কৃষ্ণা দেবী।মেয়ে অসুস্থ এই খবর পেয়ে ছুটে এসে সমস্তটা আন্দাজ করতে পারেন তারা। উমার সোনার বর্ণ শরীর এখন কয়লার বর্ণ ধারণ করেছে, কুঁকড়ে জড়ো হয়ে গেছে শরীরের সমস্ত চামড়া।কোন রকমে ধুকপুক করে চলছে শ্বাস-প্রশ্বাস।ডাক্তারবাবুরা কোন আশ্বাস দিতে পারেন নি।শরীরের প্রায় সবটাই পুড়ে গিয়েছে, বাঁচার কোন সম্ভাবনাই এখন আর নেই। বুক চাপড়ে রতনবাবু চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন, "আমিই তো তোর খুনি মা , আমিই নিজেই তো হাতে করে তোকে এই মানুষ রূপী পশুদের হাতে তুলে দিয়েছি। তুই আমাকে ক্ষমা করিস না মা। আমাকে নিজে হাতে শাস্তি দে মা , এই বাবাকে ক্ষমা করিস নে মা তুই... ।" বিজয়া দশমীর সকালেই উমার এই যন্ত্রণাময় জীবনের অবসান হল। আজ উমা এক্কেবারে স্বাধীন... এই খোলা আকাশের বুকে তার আজ চিরমুক্তি...।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register