Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া

maro news
কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া

বাপজানের শরীরের ঘ্রাণ

আমাদের বাড়িটা বাংলাদেশের অন্য দশটা মফশ্বল শহরের গ্রামীণ জনপদে৷ উপন্যাসের বর্ণনার মতো একটি ছোট্ট গ্রাম৷ গুটি কয়েক পরিবারের বসবাস৷ এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা কৃষি নির্ভর৷ গতবাঁধা সেই গৃহস্থালী কাজেই কাটিয়ে দিচ্ছে যুগের পর যুগ৷ ভোর বেলা পান্তা ভাত উদরপূর্তি করে কাঁধে জোয়াল-লাঙ্গল আর গরু নিয়ে জমিনে যেতে হয় চাষাবাদের জন্য৷ যেখানে নির্মিত হয় স্বপ্ন বুনন৷ কিষাণীদের এখানে দম ফেলবার ফুসরত নেই৷ এ সমাজে স্ট্যাটাসের বালাই নেই৷ শুধুই নিরন্তর সংগ্রাম বেঁচে থাকবার৷ এখানে রাত নামে রাত আসার আগেই৷ শিশুদের শিক্ষার চিন্তা শুধুই অভিলাস৷ কৃষিকাজের বাহিরে এখানের অনেকে কামলা দেয়া, বাঁশের কাজ কিংবা রিক্সা চালিয়ে রোজগার করেন৷ খাদ্য ঘাটতি, মঙ্গা প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ৷ এ গ্রামের পাশ দিয়ে একটা ছড়া নদী বয়ে গেছে৷ স্বপ্নের মত লাগে৷ বর্ষাকাল ছাড়া পানি থাকে না বেশিদিন৷ নদীতে যখন পানিতে ভরপুর হয়৷ তখন এখানকার লোকের রোজগারের আর একটা পথ খুলে যায় মাছ আহরণের মাধ্যমে৷ অন্যসময় নদীতে হাঁটুজল থাকে৷ তখন আমরা ছোটরা মশারি কিংবা গামছা দিয়ে মাছ ধরি৷ মাছ শিকার যে কত মজার তা বোঝানো যাবে না৷ এ গ্রামে কোন বিদ্যূত নেই৷ বড় বড় জায়গা নিয়ে একেকটি বাড়ি৷ প্রত্যেক বাড়ির ভেতর একটা আঙ্গিনা আর বাহিরের দিকে খুলিবাড়ি৷ এখানেই কৃষকের ধান মাড়া, শুকানো হয়৷ একদিকে গরুর খাবারের চাড়ি, পোয়ালের পুঁজ বর্তমান৷ আমরা একভাই, এক বোন৷ এত কম সন্তানের জন্য বাপজান আর মাকে কটু কথা শুনতে হতো৷ আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে একটা মেঠোপথ বড় রাস্তায় মিলিত হয়েছে৷ বাপজানের বাড়ির ভিটেটুকু ছাড়া নিজের কোন কৃষি জমি ছিলনা৷ উনি বর্গাচাষি ছিলেন৷ তাই সংসারের প্রাত্যাহিক চাহিদা মেটানোর জন্য রিক্সা চালাতেন৷ উনার তেমন কিছু না থাকলেও স্বপ্ন দেখতেন দিন বদলের৷ তাই তিনি আমাদের দুই ভাই-বোনকে পড়ালেখার জন্য উৎসাহ দিতেন৷ গ্রামেরা লোকেরা টিটকিরি করলেও আমাদের লেখাপড়ায় কখনো ব্যাঘাত ঘটাতে দেননি৷ নিজে না খেয়ে, না পড়ে আমাদের চাহিদা মেটাতে তৎপর ছিলেন৷ পাশাপাশি মা সেলাইয়ের কাজ করে যে অর্থ পেতেন তা দিয়ে সংসারে আর্থিক Contribute করতেন৷ পুরো পরিবারের মূল্যবান সম্পদ বলতে মা'র সেলাই মেশিনটা৷ সিঙ্গার কোম্পানীর৷ যেটা বিয়ের সময় নানা তাকে উপহার দিয়েছিল৷ না-কি যৌতুক জানি না৷ মা সব সময় টেনশন করতেন শেষে না আবার সেলাই মেশিনটা চুরি হয়ে যায়৷ তাই মা বেশি একটা বাড়ি ছেড়ে বাহিরে যেতেন না৷ বাপজান যে বিছানাতে শুতেন৷ সেটা বেশ উচু আর প্রশস্ত খাট৷ এটাকে মাইফোস বলে৷ এর বিছানার নীচে বড় ধরণের একটা কুটোরি বা সিঁন্দুক ছিল৷ বাড়ির সমস্ত দামী জিনিষগুলো নিরাপত্তার জন্য সেখানেই রাখা হতো৷ সেলাইয়ের কাজ না থাকলে মা সেলাই মেশিনটা ঢুকিয়ে রাখতেন৷ মাইফোসটা বাপজান পৈত্রিকভাবে পেয়েছেন৷ এটা আসলে ছিল আমার দাদাজানের৷ বাপজান খুব পান আর বিড়ি খেতেন৷ উনি বিড়ির প্যাকেটটা সব সময় হারিকেনের উপরে রাখতেন যাতে ড্যাম্প না হয়৷ বাড়িতে একটাই হারিকেন ছিল৷ বায়োজিদ হারিকেন৷ অন্যান্য ঘরে নেম্পো (কুপি) ব্যবহার হতো৷ সেসময় উনার একটা মূল্যবান ও শখের জিনিষ ছিল৷ সেটা হলো লাইটার৷ লাইটারটা জ্বলতো কেরোসিন দিয়ে৷ উপরে একটা সলতে৷ যেটায় আগুন জ্বলতো৷ বাপজান রাতে ভাত খাবার পর মাইফোসটার উপর পা তুলে বসতেন৷ তারপর শাহজাদি জর্দ্দা দেয়া একটা পান মুখে দিয়ে গল্প বলতেন৷ পানটা অর্ধেক চিবুনোর পর উনি ঠৌঁটে বিড়িটা নিয়ে যখন লাইটারটা জ্বালাতেন৷ তখন বাপজানকে দেখতে কী-যে ভাল লাগতো! মনে হতো সামন্তযুগের কোন জমিদার৷ সেই সময় বাপজান খুব মুডে থাকতেন৷ আমাদের দুই ভাই বোনকে দু'হাতে বুকে জড়িয়ে ধরতেন৷ খুশিতে আমরাও জড়িয়ে ধরতাম৷ আহ্! কী সুখ৷ সেসময় একটা জিনিষ বেশি আকর্ষণ করতো সেটা হলো বাপজানের শরীরের ঘ্রাণ৷ পান আর বিড়ির মিশ্রনে বাপজানের শরীর থেকে অন্যলোকের যেন এক মহা দামী আর ভাল লাগা ঘ্রাণ তৈরি হতো৷ যা আর কারো নেই৷ এটা শুধু আমার বাপজানের শরীরের ঘ্রাণ৷ এর প্যাটার্ণ আর কারো নেই৷ কখনো কেউ পাবে না৷ বাপজান যখন সকাল বেলায় রিক্সা নিয়ে বের হয়ে যেতেন৷ তখন আমরা দু'ভাই বোন ঘুমিয়ে থাকতাম৷ মা বলে প্রতিদিন তোদেরকে চুমু দিয়ে তোর বাপজান চলে যায় তোরাতো টেরই পাসনা৷ বিকেল বেলা স্কুল থেকে এসে আমরা দু'জনে সন্ধ্যে পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম৷ বাপজান ফিরলে দৌড়ে যাব৷ কিছুনা কিছুতো নিয়ে আসবেই৷ সন্ধ্যায় আমরা বাড়ির সামনে রাস্তার একটা গাছের নীচে অপেক্ষা করতাম৷ বাপজান আসে না কেন? দেরি করলে তাঁর সাথে আড়ি৷ হঠাৎ ক্রিং ক্রিং করে রিক্সার বেল শুনতে পেয়ে দৌড় লাগাই৷ বাপজান আসছে! বাপজান আসছে বলে চিৎকার করতাম৷ উনি প্রতিদিন একই জায়গায় এসে রিক্সাটাকে দাঁড় করিয়ে বেল বাজাবেন৷ যাতে আমরা দৌড়ে গিয়ে রিক্সায় উঠে বসি৷ আর বাকি পথটুকু সকলে রিক্সা করে বাড়িতে পৌঁছাই৷ এই চলার পথেই উনি হয় নাদি চকলেট, নাবিস্কো চকলেট, গ্লুকোজ বিস্কুট কিংবা ফেন্সি বিস্কুট কিছু না কিছু হাতে ধরিয়ে দেবেন৷ বাপজান রিক্সা চালাচ্ছে আর আমরা ভাই বোন রিক্সায় বসে বিস্কুট খাচ্ছি৷ কী-যে খুশি! আহ্! এভাবেই আমাদের চলছিল বেশ৷ আমি মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছি৷ ছোটবোন মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী৷ গ্রামটা আর আগের মত নেই৷ চারিদিকে পরিবর্তন৷ গ্রামের বেশিরভাগ অধিবাসী বিবর্তনের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে৷ জমি বেচে মাইগ্রেট করেছে৷ নতুন নতুন বিত্তবানরা তৈরি করেছে বহুতল ভবন৷ মেঠোপথটি এখন পাকা সড়ক৷ বিদ্যূতের কারণে আলোকিত গ্রাম৷ শুধু অসীম সাহসী আর স্বপ্নের যাদুকর বাপজান টিকে আছে মিটমিটে প্রদীপের ন্যায়৷ নতুন জেগে উঠা এই অভিজাত এলাকায় এক নিতান্তই রিক্সাচালকের বিদ্যূতহীন, দৈন্য আর খড়ের বাড়ি কোনভাবেই বরদাস্ত করছে না নতুন কমিউনিটি৷ কিন্ত আমাদের দু'ভাই বোনের শিক্ষাগত যোগ্যতা আর আগামী ভবিষ্যৎ তাদের জন্য ঝুকি হতে পারে ভেবে পিছু হটছে বারংবার৷ ছুটিতে বাড়িতে আসলে পুরোনো অভ্যাসবশতঃ এখনো আমরা বাপজানের জন্য অপেক্ষায় থাকি৷ সেদিনও অপেক্ষা করতে থাকলাম৷ এই বুঝি বাপজান এলো৷ কিন্ত উনার আসার কোন হদিস নেই৷ আকাশ মেঘলা৷ ঝড় হচ্ছে৷ রাত হয়ে যাচ্ছে৷ বাপজান আসছে না৷ মা কান্নাকাটি করছে৷ আমরা চিন্তিত৷ এমন সময় সেই প্রিয় শব্দ ক্রিং ক্রিং শুনে দৌড় দিলাম৷ গিয়ে বললাম বাপজান এত দেরি করলে কেন? তোমার সাথে কোন কথা বলবো না৷ নিশ্চুপ চারিদিক৷ লোড শেডিংএর কারণে কিছু দেখা যাচ্ছে না৷ আবছা আলোয় দু'জন মানুষ বড় কিছু একটা দু'হাত দিয়ে নামাতে নামাতে বললো৷ তোমাদের বাপজান আর নেই৷ উনি এক্সিডেন্ট করেছেন৷ উনি এখন মৃত৷ ওনারা কী বলছেন? কানে কিছু শুনছি না৷ মাথায় কিছুই ঢুকছে না৷ চিৎকার করে মাটিতে শুয়ে থাকা বাপজানকে জড়িয়ে ধরলাম৷ কিন্ত একি এখনো তাঁর শরীর থেকে সেই মাদকতাপূর্ণ ঘ্রাণ পাচ্ছি৷ নাহ্ বাপজান মরেনি! চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম৷ কিন্ত তাতে লাভ হলোনা৷ কেননা কান্না দিয়ে মৃতকে জীবিত করা যায় না৷ বছর দশেক পর বাপজানের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে মাকেও হারাই৷ ছোট বোন ডাক্তারি পাশ করে বিসিএস কমপ্লিট করে RMO হিসেবে যশোরে থাকে৷ ওর স্বামীও ডাক্তার৷ আমি এখন একজন সরকারি কর্মকর্তা৷ পুরোনো বাড়ি ভেঙ্গে নতুন বিল্ডিং করেছি৷ সেই বাড়িতে এখনো আমরা চারজন থাকি৷ আমি, আমার স্ত্রী ও আমাদের পুত্র-কণ্যা৷ আমি অফিস থেকে বিকেলে যখন ফিরি ড্রাইভারকে গাড়িটা সেখানেই থামিয়ে হর্ণ দিতে বলি৷ যেখানে বহু বছর আগে আমাদের জন্য বাপজান রিক্সাখানা দাঁড় করিয়ে বেল বাজাতো৷ এখন আমার পুত্র-কণ্যা ঠিক সেভাবেই দৌড়ে আসে৷ আর বলতে থাকে বাবা এসেছে৷ বাবা এসেছে৷ আমিও প্রতিদিন ওদের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসি৷ কমলা, আপেল, মাল্টা, আইসক্রিম কিংবা পিৎজা৷ গাড়িতে তুলে নিয়ে খাবারগুলো ওদের হাতে তুলে দেয়ার যে কী আনন্দ৷ তা একদা বাপজান বুঝেছিল৷ আমরা বুঝিনি৷ আজ আমি বুঝছি তা সন্তানেরা বুঝবেনা৷ কাহিনী এক৷ কনটেক্সট এক৷ শুধু সময়টুকু আলাদা৷ যেন একই চিত্রনাট্যের পুনরাবৃত্তি৷ অথবা সাদাকালো ছবির রঙ্গিন ভার্সন৷ ওদের হাসিমাখা মুখটা দেখে যখন জড়িয়ে ধরি৷ তখন সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যাই৷ তখন আমি নিজেকে আবির্ভাব করি সেই ছোট্ট ছেলেটির মাঝে যা সে ফেলে এসেছে বহুকাল পূর্বে৷ আর সৃষ্টি হয় হেল্যুসিনেশন৷ দেখি বাপজান হাসছে৷ জর্দ্দামাখা লাল ঠৌঁটে বিড়ির ধোঁয়ায় তাঁকে অস্পষ্ট লাগছে৷ চোখ বন্ধ করে খুব জোড়ে শ্বাস নিলাম৷ যাতে ফুসফুসে ভরে থাকে মাদকতায় ভরা সেই প্রিয় ঘ্রাণ৷ চোখ খুলে দেখি বাপজান অদৃশ্য৷ শুধু নাকে এখনো লেগে আছে নস্ট্রালজিক করা বাপজানের শরীরের ঘ্রাণ৷
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register