Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

T3 || স্তুতি || শারদ 26য় কবিতা চক্রবর্ত্তী

maro news
T3 || স্তুতি || শারদ 26য় কবিতা চক্রবর্ত্তী

একটা অন্যরকম রাত দখল

ভিতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না ভেবে ঘরের ভিতর ঢুকেই পড়লো উমা । শাশুড়িকে ভীষণ ভয় পায় সে।। শুধু শাশুড়ি কেন ,এই বাড়ির সবাইকেই সে ভয় পায়। এক মাত্র শশুর মশাইকে ছাড়া। উমার তাকে একদম নিজের বাবার মত মনে হয় । মুখে ' মা ' ছাড়া কথা নেই। উমার পছন্দের জিনিসগুলো কিনে নিয়ে এসে সবার চোখ বাঁচিয়ে সবার প্রথম তার হাতে দেন। বাজার যাওয়ার সময় কি মাছ খাবে সেটা জেনে যান তার কাছে। সারাদিন কত গল্প করেন উমার সাথে। আর কেউ এটা পছন্দ করেনা। কারণ আর সবার চোখে এটা আদিখ্যেতা। নিজের মেয়ে থাকতে পরের মেয়েকে এত ভালোবাসার কি আছে? এটা অবশ্য শাশুড়ি মা বলেন । একমাত্র ছোটো ননদ সুমি। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। সে ও মায়ের দলে। আর উমার স্বামী? সে তো মায়ের বাধ্য ছেলে। মা বললে উঠবে, মা বললে বসবে। এই বাড়িতে সব কিছুই মায়ের কথা মত হয়। শশুর মশাইয়ের কিছু বলার ক্ষমতা নেই ওদের ওপর দিয়ে। তাই তিনি চুপচাপই থাকেন। উমাকে দেখেই শাশুড়ি মা বলে উঠলেন, -- কি ব্যাপার,আমার ঘরে এই সময়? দেখো বাপু, বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা বোলো না কিন্তু। সবে তিনমাস হলো ওই বাড়ি থেকে এসেছো। এখনি আবার যাই যাই কোরো না । রান্নাবান্নার দায়িত্ব এই বয়েসে আমি আর নিতে পরিনা। সাথে সাথে উমা বলে উঠলো, -- না, মা। বাপের বাড়ি যাবো না। আজ রাতে একটু অন্য জায়গায় যাওয়ার কথা বলছিলাম। ভুরু কুঁচকে শাশুড়ি মা বললেন, -- রাতে অন্য জায়গায় মানে!!! কোথায় যাবে ? খোকা জানে? একটু ইতস্তত করে উমা বললো, -- না মা,অন্য কোথাও না। এই সামনেই। চৌরাস্তার মোড়ে। পেপারে , খবরে, সব জায়গায় দেখছেন না, মেয়েরা আজ রাত দখল করবে। মাঝরাতে রাস্তায় হাঁটবে আজ মেয়েরা। অবশ্য অনেক পুরুষও থাকবে। যারা এটাকে সমর্থন করে। রাতে বেরোনো যে মেয়েদেরও অধিকারের মধ্যে পরে, সেটার জন্য এই রাত দখল একদিনের। মেয়েদের ওপর এই যে অত্যাচার,তার প্রতিবাদেই আজকের এই রাতদখল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আজ মেয়েরা এতে সামিল হবে নিজের নিজের এলাকাতে। অনেক পুরুষ ও থাকবে সাথে। যারা মেয়েদের এই প্রতিবাদ সমর্থন করেন। আমাদের বাড়ির কাছেই ওই চৌরাস্তার মোড়ে রাত বারোটায় আজ হবে। আমি যাবো ওখানে মা। আপনাকে বলতে এলাম। খাটে বসেছিলেন শাশুড়ি মা। এক লাফে উঠে সামনে চলে এলেন। কি মূর্তি তার তখন। রেগে আগুন হয়ে বললেন, -- তোমার সাহস হয় কি করে একথা বলার? আমাদের বাড়ির মেয়েরা মাঝরাতে বাড়ির থেকে বেরিয়ে মিটিং মিছিল করেনা। সে সব যারা করে করুক। ওসব আলাদা মেয়ে। আমাদের বাড়িতে এসব হবেনা। তোমার এই কথা খোকা জানে? উমা আমতা আমতা করে বলল, -- মা , আপনারও তো একটা মেয়ে আছে। তার সাথে যদি এমন কিছু খারাপ ঘটনা ঘটে, তখনও কি আপনি এটাই বলবেন? প্রতিবাদে তো আপনারও যাওয়া উচিত আজ। আমরা নিজেরাই তো নিজেদের শক্তি হতে পারি। একটা দিনের প্রতীকী প্রতিবাদ না শুধু। প্রত্যেকটা মেয়ের অধিকার আছে তার ইচ্ছে মত বাঁচার। রাতে মেয়েরা বেরোতে কেন ভয় পাবে? রাত টা তো তারও। না, শাশুড়ি মা কোনো কথাই শুনতে চাইলেন না। খুব বাজে ভাবে অপমান করলেন। উমার নাকি নেত্রী হওয়ার সখ হয়েছে, বাইরের লোকের সাথে মাঝরাতে গল্প করতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে, আরো অনেক কথা শুনিয়ে একরকম ঘরের থেকে বাইরে বের করে দিলেন কাঁদতে কাঁদতে বাইরে বেরিয়ে উমা দেখলো,শশুর মশাই ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। তিনি উমাকে বললেন, -- কাঁদিস না রে মা। জানিস তো তোদের মেয়েরাই কিন্তু মেয়েদের সব থেকে বড় শত্রু। তুই কষ্ট পাস না। দেখি আমি যদি রাজি করাতে পারি, আমি নিজে তোকে নিয়ে যাবো। আমারও খুব ইচ্ছে তোদের মেয়েদের সাথে এই প্রতিবাদে সামিল হই। না, তিনিও রাজি করাতে পারেননি। আসলে এই বাড়িতে তার কথাও কেউ শোনে না যে। শাশুড়ির কথাই যে এই বাড়ির শেষ কথা। তার অন্যথা হওয়ার উপায় নেই। মানব অফিস থেকে ফিরলো সন্ধ্যার পর। উমা জানতোই যে শাশুড়ি মা, ঠিক ছেলের কানে এই কথাটা তুলবেন। আর তারজন্য মানব আবার তার সাথে অশান্তি করবে। আর ওর অশান্তি মানে তো রেগে গিয়ে মাঝে মাঝেই গায়ে হাত তোলা। অনেকবার ভেবেছে এটার একটা প্রতিবাদ করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। একটা ভয়, আতঙ্ক, লজ্জা যেন কেমন মনের মধ্যে চলে আসে,তাই প্রতিবাদটা করা হয়ে ওঠেনা। শশুর মশাই ছেলেকে বকা দেন, প্রতিবাদ করেন। কিন্তু সেই কণ্ঠ এত দুর্বল,যে তাতে ছেলের কিছুই যায় আসে না। আর শাশুড়ি মা তো তাতে বেশ খুশিই হন। আজও তার অন্যথা হলো না। কেন সে রাতে যাওয়ার কথা বলেছে, মার ওপরে কেন কথা বলেছে, এইসব নিয়ে অনেক অশান্তি করলো মানব। বাজারের মেয়ে, বাপের বাড়ির শিক্ষা নেই,এরকম আরো অনেক কথা বলতে বলতে আজও উমর গায়ে হাত তুললো মানব । আজ একটু প্রতিবাদ করেছিলো সে। তার শাস্তিl যদিও সেই প্রতিবাদী কণ্ঠে কোনো জোর ছিলনা। তবুও ,মুখে মুখে কথা বলার জন্য স্বামীর কাছে মার খেতে হলো। কাঁদতে লাগলো উমা। কি এমন দোষের কথা বলেছিল সে? এত মেয়েরা , পুরুষেরা প্রতিবাদ করছে,সেখানে কিছুক্ষণের জন্য যেতে চেয়েছিল সে। খবরের কাগজ,টিভি, সব জায়গায় মেয়েদের এই প্রতিবাদের কথা। প্রতিবাদে সামিল হওয়ার ডাক। সেই ডাক সে উপেক্ষা করে কি ভাবে? সেও তো একজন মেয়ে। তাহলে আর একজন মেয়ের জন্য বা সব মেয়েদের জন্য এই টুকু সে করতে পারবে না? বুঝে উঠতে পারেনা উমা,তার দোষ টা কোথায়? এই টুকু স্বাধীনতা যদি না থাকে,তবে কিসের মানুষ সে? প্রচণ্ড অভিমানে সেই রাতে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ল উমা। না কেউ তাকে ডাকতে আসেনি। মানব ও একবারও তাকে খাবার কথা বলেনি। ঘন্টাখানেক পর। সবাই ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ একটা চিৎকার। মানবের গলার আওয়াজ। উমার শশুর শাশুড়ি ননদ সবাই উঠে বাইরে বেরিয়ে এলো উমাদের ঘরের সামনে। ওদিকে ' বাবা রে ' ' মা রে ' মেরে ফেললো আমাকে, বলে চিৎকার করছে মানব। দরজা ধাক্কাতে লাগলো সবাই বাইরে থেকে। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে থাকলো। দরজা খুলে দিলো উমা। আলুথালু জামা কাপড়। ঘরের মধ্যে ঢুকে সবাই দেখলো, বিছানার ওপরে বসে মানব কাতরাচ্ছে । ডান হাতটা খুব ফুলে গেছে। কাঁধের কাছে কামড়ানোর দাগ। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। সবাই জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে? উত্তরটা উমাই দিলো। শাশুড়ির সামনে গিয়ে বলল, -- আমি বাড়ির বাইরে না বেরিয়েও রাত দখল করতে পেরেছি মা। হোক না সে একটা মাত্র রাত। তাও আজ আমি পেরেছি একটা রাত অন্তত নিজের দখলে রাখতে। অনিচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো পুরুষের কাছে নিজের শরীরটা সপে দেওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছি নিজেকে। হোক সে আমার স্বামী। শরীর আমার,ইচ্ছেটাও শুধুই আমারই হবে। আপনার ছেলের হাতটা মুচড়ে আমি ভেঙে দিয়েছি। কাঁধে কামড়ে দিয়েছি আমি। আজকের আমার রাতদখল আমি বাড়িতে থেকেই করেছি। সবাই চুপ করে থাকলো। শুধু শশুর মশাইয়ের মুখে হাসি। উমা জানে,আজ সব থেকে খুশি এই মানুষটাই হয়েছেন। কারণ উনি সবসময় বলেন,আমি পারিনা কিন্তু তুই পারিস। প্রতিবাদ তোকেই করতে হবে। কাউকে লাগবে না,যখন মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের শক্তি হবে। আর সেইদিন বেশি দেরী নেই রে। তোরা তো শক্তির অংশ। তোরা না পারলে কে পারবে? তোদের কে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে যে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register