Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

গদ্যানুশীলনে সুব্রত সরকার

maro news
গদ্যানুশীলনে সুব্রত সরকার

পিতা- পুত্রী

খবরের কাগজের এককোণায় খবরটা বোল্ড করে ছাপা হয়েছে- "আমেরিকায় পথ দুর্ঘটনায় তিন ভারতীয়র মৃত্যু।" সঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাড়িটার এক বিভৎস ছবি। এবং তার নীচে ক্যাপশন ''সাউথ ক্যারোলাইনার গ্রিনভিল কাউন্টিতে এই ভয়ংকর দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তিন ভারতীয় মহিলা!..''

খবরটা পড়েই মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে কৃশানুর। প্রথমেই মনে পড়ে মেয়ের কথা। ওতো সাউথ ক্যারোলাইনাতেই থাকে। পি এইচ ডির স্টুডেন্ট।

বুকটা কেমন ধরফর করতে থাকে। ডুবে যায় নিমেষে কাগজের মধ্যে। খবরটা এবার পড়তে গিয়ে জানতে পারেন, না। যারা তিনজন মারা গেছেন, তাঁরা অচেনা অন্য ভারতীয়।

কৃশানু কাগজ বন্ধ করে উঠে পড়েন। বেসিনে গিয়ে চোখে মুখে জল দেন। শরীরটা কেমন অস্থির হয়ে পড়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। ধাতস্থ হতে সময় নেয়। সন্তান স্নেহ বড় বিষম! মুহূর্তে সব কেমন হয়ে গিয়েছিল।

খবরে লিখেছে, ওভারস্পিডিং এর জন্যই গাড়িটা ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে কুড়ি ফুট দূরে উড়ে গিয়ে পড়ে। এবং ঘটনাস্থলেই তিন মহিলা যাত্রীর মৃত্যু হয়। ওরা সাউথ থেকে নর্থ ক্যারোলাইনায় যাচ্ছিলেন।

মেয়েকে একটা ভিডিও কল করার কথা ভাবেন। একটু সাবধানে থাকতে, রাস্তা ঘাটে, গাড়িতে সতর্ক ভাবে চলাফেরা করার কথা বলে দেওয়া দরকার মনে মনে ভাবেন কৃশানু।

কল করবেন কি করবেন না ভাবতে ভাবতেই মনে এক অন্য ভাবনা এসে যায়, একটু ভুল, চালকের বেপরোয়া মনোভাব এই ভয়ংকরকে ডেকে আনল। ভাবতে ভাবতে কৃশানু হারিয়ে যান সেই অচেনা তিন পরিবারের কথা মনে করে, প্রিয়জনদের হারিয়ে তাঁরা এখন কি করছেন, কিভাবে সামলাচ্ছেন এই শোক!

সন্তান স্নেহে অন্ধ মন এখন কেমন যেন সমব্যথীর বেদনায় মুচড়ে ওঠে। আবার শুরু হয় এক অস্থিরতা শরীরে। চোখে মুখে জলের ছিটে দেন। তবু এই অস্থিরতা যায় না। মন খারাপ মন নিয়ে বারান্দার নির্জনতায় চলে যান। এই চাপা কষ্ট, এই বেদনার বোধ আজকের সকালটাকে বড় বিষন্ন করে তুলল!

ঘরের ভেতর হঠাৎ বেজে ওঠা মোবাইল থেকে শব্দ ঝংকার ভেসে আসে। এতো পরিচিত শব্দ। মেয়ের ভিডিও কলের আওয়াজ!..কিন্তু এই অসময়ে কেন? কৃশানু ছুটে যান ঘরে। একদম শেষ মুহূর্তে কল রিসিভ করে বলেন, "হ্যাঁ। বল।"

"তুমি কোথায় ছিলে?"

"এই তো একটু বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।"

"শরীর ঠিক আছে তো?"

"হ্যাঁ। ঠিক আছে। তুই হঠাৎ ফোন করলি কেন?"

" সাবধানে থাকবে। একা বাড়িতে থাকো তো!"

"এসব হঠাৎ বলছিস কেন?"

"এই তো একটু আগে জানলাম, সল্ট লেকের এক বাড়িতে ডাকাতি করতে এসে একজন সিনিয়র সিটিজেনকে খুন করে চলে গেছে। উনি একা থাকতেন।"

"ওসব সল্ট লেকে হয়। আমাদের এখানে এসব ভয় নেই।"

"থাক। তোমাকে এত রিলাক্স থাকতে হবে না। একা একা থাকো। সাবধানে থাকবে।"

কৃশানু এপ্রসঙ্গ নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে বলেন, "তুই লার্নার লাইসেন্স পেয়ে গেছিস?"

"নেক্সট উইকে পেয়ে যাব।"

"বাহ্।"

"ব্রেকফাস্ট করেছো? "

"এই করব এখন। তুই ডিনার করেছিস?"

"একটু আগেই করলাম। এবার স্টাডিতে বসব।"

" বেশ। তাহলে পড়তে বস। এখন রাখি তাহলে।"

"হ্যাঁ রাখো। টা টা।"

"টা টা।"

কৃশানু মোবাইল বন্ধ করে ডাইনিং টেবিলে চুপ করে বসে পড়েন।

পৃথিবীর দু'প্রান্তে দুইজন। শঙ্কা ও উদ্বেগের কি অদ্ভুত মিল!..

জীবন বড় অদ্ভুত। এই মিল অমিলের খেলা খেলতে খেলতেই মানুষ একদিন কেমন বৃদ্ধ হয়ে যান।

কিন্তু কৃশানু বৃদ্ধের উদ্বেগ নিয়ে তো তখন বলতে পারলেন না মেয়েকে, "লাইসেন্স পেয়ে গাড়ি কিন্তু সাবধানে চালাবি!.."

কেন বললেন না এই কথাটা? যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে চলে গেছে বহূদরে, সে তো আরও দূরে যাবে! তাকে এসব মামুলি কথা বলে সতর্ক করা কি খুব দরকার!..

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register