Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী

maro news
দৈনিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী

বৃহন্নলা কথা 

সেই যে তৃতীয়া প্রকৃতির মানুষটি নিজের যৌন অস্তিত্বের সংখ্যালঘুত্বের কারণে দুর্বিষহ যন্ত্রণা পেয়ে আত্মহত্যার উদ্দেশে বনে গিয়েছিল, অন্য মানুষ যাকে সমবেদনা যোগায় নি, এক যক্ষ এল তার উদ্ধারে।
এই যক্ষটির নাম হল স্থূণাকর্ণ। সে কুবেরের অনুচর। তৃতীয়া প্রকৃতির মানুষটির বিপন্নতা তাকে ছুঁয়ে গেল। স্থূণাকর্ণ চাইলো নিজের পরিবারের কাছে আক্রান্ত মানুষটির যথাযোগ্য পুনর্বাসন। সে নিজের পৌরুষ তাকে দান করল। বললো আমার পৌরুষের সম্বলে তুমি আপাততঃ নিজের শঙ্কিত অস্তিত্বের পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা নাও। বিপন্ন মানুষটি জানতে চাইল, তোমার কি হবে? যক্ষ স্থূণাকর্ণ জানালো, তুমি সংসার জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে সুবিধে মতো আমার পৌরুষ আমায় ফেরত দিও।
এক অদ্ভুত পবিত্র হাসির ছটায় ভরে রইল যক্ষটির মুখমণ্ডল।
তৃতীয়া প্রকৃতির মানুষটি সংসারে ফিরে এল, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পুনর্বাসন তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ব্র্যান্ড সচেতন মানুষের সমাজ যে লেবেলে বিশ্বাস করে। একবার লেবেল সেঁটে গেলে সেটা তোলা শক্ত। ওদিকে যক্ষ স্থূণাকর্ণ পড়ল আরেক ঝামেলায়। তার মালিক কুবের কোনোভাবে তার কীর্তি জানতে পারে এবং সরেজমিন তদন্তে এসে যাবতীয় তথ্য জানতে পারে। মালিকেরা কখনোই সংখ্যালঘুদের পছন্দ করে না। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে কুবের স্থূণাকর্ণকে অভিশাপ দিল যে, যতদিন না তার পৌরুষ গ্রহীতা তৃতীয়া প্রকৃতির ব্যক্তিটির জীবনাবসান না হচ্ছে, ততদিন তাকে এইভাবেই থেকে যেতে হবে। স্থূণাকর্ণ এর পৌরুষ পেয়ে শিখণ্ডী নামে পরিচিত হয়ে লোকটি ঝাঁপাল মহাযুদ্ধে। ভীষ্ম ছিলেন ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী। ভীষ্ম নিজে না চাইলে পরে তাঁকে আহত করাও সম্ভব ছিল না। তাই যুদ্ধের মধ্যেই অর্জুন পিতামহ ভীষ্মকে তাঁর মৃত্যু ঘটানোর কৌশল সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ভীষ্ম ছিলেন অষ্টবসুর অন্যতম। মহাতেজা ব্যক্তি। কিন্তু কুরুবংশের সম্মানিত প্রবীণ হওয়া সত্ত্বেও দুর্যোধন তার প্রতি সদাচরণ করতেন না। শক্তপোক্ত প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী আমলাদের সাথে যেমন ব্যবহার করেন, অনেকটা তেমন। এই কারণে ভীষ্ম মনোকষ্ট পেতেন। দুর্যোধন চাইছিলেন ভীষ্ম যখন অসামান্য ধনুর্ধর, তখন কেন তিনি অতি সহজেই অর্জুনকে বধ করে পাণ্ডবদের কোমর ভেঙে দিচ্ছেন না। ভীষ্ম তো আসলে দ্যু বসু। তিনি ছিলেন ইন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সহচর। আর অর্জুন ইন্দ্রের বরপুত্র। স্বভাবতঃই ইন্দ্রপুত্র অর্জুনের প্রতি ইন্দ্রসখা ভীষ্ম অনুরক্ত ছিলেন। তাই তিনি দুর্যোধনের কুৎসিত আচরণ থেকে চিরতরে মুক্তি খুঁজতে চেয়ে তাঁর নিজের প্রাণসংহারের উপায় বলে দিলেন। সেই ব্লু প্রিন্টে শিখণ্ডীকে সামনে রেখে ভীষ্মবধে এগিয়ে গেলেন অর্জুন। সেটা যুদ্ধের দশম দিন। ভীষ্ম এর প্রতি নয় নয় খানা বাণ ছুঁড়েছিলেন শিখণ্ডী। তাঁর পিছন থেকে বাণ ছুঁড়েছিলেন অর্জুন। বুক পেতে বাণ বরণ করতে করতে স্থূণাকর্ণ যক্ষের পৌরুষের সজ্জায় সজ্জিত তৃতীয়া প্রকৃতির মানুষটিকে অপলক তাকিয়ে দেখতে থাকেন ভীষ্ম। আমাদের গঙ্গাপুত্র, ইন্দ্রসখা দ্যু বসু। জলভরা চোখে দেখতে থাকেন ক্লীব পরিচয়ের আড়ালে অভিমানিনী অম্বাকে। সে মেয়ে যে বড়ো করুণভাবে বলেছিল আমাকে এভাবে টেনে আনলেন কেন, আমি যে শাল্বকে ভালবাসি। শাল্ব সেই অম্বাকে পরপুরুষ সংসর্গ দোষে প্রত্যাখ্যান করলে দেবব্রত ভীষ্মকেই চেয়েছিল অম্বা। আহা তার নারীজন্ম যে নিষ্ফলা চলে যাবে! সেদিন ভীষ্ম সে মেয়েকে গ্রহণ করেন নি। গুরু পরশুরাম বোঝাতে চাইলেও বোঝেন নি। সে মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। বার বার জন্মেছে আর বার বার ভীষ্মের মৃত্যুকামনা করেছে। তারপর অম্বার ক্লীবজন্ম। ভীষ্ম চেয়ে থাকেন, আর ক্লীব শরীরকে ডিঙিয়ে বাণ ছুঁড়তে থাকে একটি প্রশ্নাতুর মেয়ে। সে অম্বা।
ক্রমশ.....
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register