প্রবন্ধে মীনাক্ষী লায়েক
তিন তালাক বিল
সম্প্রতি ভারতে মুসলিম সমাজের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা তাত্ক্ষনিক তিন তালাক প্রথা নিষিদ্ধ হলো আইনের মাধ্যমে। গত বছরই আগস্ট মাসে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট এই প্রথাকে অসংবিধানিক অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ইসলাম ধর্মপালনের সঙ্গে এই তাত্ক্ষণিক তিন তালাক প্রথা কোনভাবেই জড়িত নয় বলে জানিয়েছিলেন সর্বোচ্চ আদালত। এখন এই প্রথা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়েছে। তিনবার 'তালাক' উচ্চারণ করে স্ত্রীকে বিবাহবিচ্ছেদ দিলে এই আইন অনুযায়ী মুসলিম পুরুষদের তিন বছরের জেল এবং আর্থিক জরিমানা হবে। তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর খোরপোষ পাবারও অধিকার থাকবে। গত বছরের শেষের দিকে এই প্রথার বিরুদ্ধে আইন করে শাস্তিযোগ্য করার জন্য কেন্দ্রিয় সরকার (বি জে পি) 'দ্য মুসলিম উওম্যান প্রোটেকশন অফ রাইটস ইন ম্যারেজ এক্ট ' নামে বিল আনে এবং লোকসভাতে তা পাশ হয়ে গেলেও রাজ্যসভায় আটকে যায়। সম্প্রতি অর্ডিনান্সের মাধ্যমে সরকার তা আইনে রূপান্তরিত করলো। ৷ আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছেন মুসলিম নারীদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতেই এই আইন। সমর্থকেরা আইনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন মুসলিম মহিলারা অনেক নিরাপদ হলেন। কারণ, এই প্রথার জন্য এতদিন মুসলিম নারী তার স্বামী দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন। লিখিত, মৌখিক, বৈদুতিন মাধ্যমে তাত্ক্ষণিক তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ (তালাক-ই-বিদাত) এর জন্য পরবর্তী জীবনে তাদের দুর্দশার সীমা ছিল না। এখন এই আইনে তাতক্ষণিক তালাক প্রথা অবৈধ তো হলই, বিচ্ছিন্না স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নির্ধারিত খরপোষ দিতে বাধ্য থাকবেন স্বামী। নাবালক সন্তানেরাও মায়ের হেপাজতে থাকবে। একমাত্র ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মতিতেই ধার্য হবে এই বিচ্ছেদ। তাত্ক্ষণিক তিন তালাকের অভিযোগ নিতে বাধ্য থাকবেন কর্তব্যরত পুলিস। বিরোধীরা যুক্তি দেখান ভালো করে পরিস্থিতি বিচার করার জন্য তিন তালাক বিলটিকে একটি সংসদীয় সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়ে ভালো করে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন ছিল কারণ ফৌজদারি শাস্তি বিধানে মানুষের হয়রানি ও অপব্যবহারের সুযোগ থাকবে। অন্যদিকে মুসলিম কিছু সংগঠন এই বিলের বিরোধিতা করেছে শুরু থেকেই। তাদের কথামতো এই আইন ইসলামী শরিয়তের ওপর হস্তক্ষেপ। দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দের প্রিন্সিপাল মুফতি আবুল কায়েম নোমানি বলেন মোদি সরকার তিন তালাক বিল পাশ করে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের অধিকার হরণ করেছে। সব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে, এটি মুসলমানদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ের উপর আক্রমণ।
এই আইন প্রনয়নে সরকারের দলের সমর্থকেরা খুশী। খুশী অনেক মুসলিম তালাকসুদা রমনীও। তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ যন্ত্রণাময় জীবনের ভার আর আগামী মুসলিম নারীদের বহন করতে হবে না ভেবেও তারা উল্লসিত। অবশ্যই সরকারের এক মানবকল্যাণমুখী সংস্কারের নজির এটি। কিন্তু যে প্রথাটি মুসলিম সমাজেই বৈধ নয়, সেই অবৈধতাকে নতুন করে আইন করে অবৈধ ঘোষণা করার প্রয়োজন হলো ভারতবর্ষে। কারণ তাত্ক্ষণিক তিন তালাক এমনিতেই শরিয়ৎ বিরোধী। একটু ভেতরের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।
হজরত মুহাম্মদ বলেছেন, "তালাক হলো ঘৃণ্যতম বৈধ কাজ"। তিনি আরও বলেছেন " বিয়ে করো কিন্তু তালাক দিয়ো না। কেননা তালাক দিলে তার দরুণ আল্লাহর আসন কেঁপে ওঠে"। (আবু দাউদ তিরমীজী শরিফ)
বিবাহ হলো নর ও নারীর একত্র সহাবস্থানের জন্য এক আইনসঙ্গত বন্ধন এবং এ বন্ধন পবিত্র। বিবাহের মাধ্যমে পারস্পরিক খুশী, বিশ্বাস, ভরসা, প্রেম, বন্ধুত্ব, দায়িত্ব, সহানুভূতি দিয়ে সংসারের ইমারত গড়ে ওঠে। প্রত্যেক ধর্মের প্রত্যেক মননশীল ব্যক্তি এই বন্ধনের স্থায়িত্বের ইতিবাচক দিকটি উল্লেখ করেন কারন, সমাজের তাতেই মঙ্গল। তাই ইসলামেও বিবাহ বা বলা ভালো সংসারকে স্থায়ী ও আনন্দময় করার লক্ষ্যে সম্ভাব্য সব রকম ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে। তবুও বিচ্ছেদ হয়, প্রত্যেক ধর্মের নরনারীর মধ্যেই হয়। দাম্পত্য জীবনে বিবাদ বিরোধ মনোমালিন্য চরম আকার ধারণ করলে বিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদ স্বাভাবিক, যদিও একমাত্র পন্থা নয়। তাই কোরাণে বলা হয়েছে "যদি কোন স্ত্রীলোক তার স্বামীর কাছ থেকে দুর্ব্যবহার কিংবা অবজ্ঞার আশঙ্কা করে তাহলে সে অবস্থায় পারস্পরিক আপোষ মীমাংসা করে নিলে তাদের দোষ নাই, কারণ আপোষ হচ্ছে উত্তম পন্থা।" (সুরা নিসা - ১২৮) আবার এও বলা হয়েছে " প্রত্যেকেই যেন অপরের ব্যাপারে নিজের মধ্যে ধৈর্য্য ও সহ্য শক্তি রক্ষা করে, অপরের কোন কিছু অপছন্দ হলে সে যেন দাম্পত্য জীবন রক্ষার স্বার্থে তা অকপটে সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। " কিন্তু এরপরেও যদি স্বামী স্ত্রী পরস্পর বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে অসফল হয় তখন কোরাণের নির্দেশ " তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে।" (সুরা নিসা - ৩৫)৷ তৃতীয় পক্ষ দ্বারা বিরোধ মীমাংসার কথা ইসলামেও আছে। তাই তৃতীয় পক্ষ দ্বারা বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা না করা হলে সে তালাক বৈধ নয়। স্ত্রী ও তার পরিবারকে কিছু জানানো হলো না, হঠাৎ উত্তেজনার বশে তিনবার মৌখিক, ফোনে কিংবা চিঠির মাধ্যমে 'তালাক, তালাক, তালাক' দিলেই তালাক হয়ে যায় না। বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পর্কে যথার্থ ইসলামিক জ্ঞান না থাকায় বিভ্রান্তি ছড়ায়। বলতে দ্বিধা নেই মুসলিমদের মধ্যে অনেক অর্ধশিক্ষিত, গোঁড়া, বাস্তববর্জিত ধর্মের ধ্বজাধারীরা কখনো নিজেদের স্বার্থরক্ষার্থে এমন শরিয়ত বিরোধী নিয়ম প্রচার করে। ক্ষতি হয়ে যায় মুসলিম নারীদের। তাই নারীদেরও বিচ্ছেদ সম্পর্কে নিয়মগুলি জানা উচিত। যতদিন তারা অন্ধকারে থাকবে ততদিন পুরুষ সমাজ তাদের চাপে রাখবে। তালাক দেওয়া অত সহজ ও ঠুনকো নয়। তৃতীয় পক্ষর সালিসিও যখন বিচ্ছেদ আটকাতে অপারক তখন শুরু হতে পারে তালাকের প্রক্রিয়া। সে প্রক্রিয়াও বেশ জটিল।
তালাক শব্দের অর্থ বন্ধন খুলে দেওয়া। শরিয়তের ভাষায় ' সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা'। স্বামী স্ত্রী র পরস্পরের সম্পর্ক এতই তিক্ত হয়ে পড়ে, সালিসরাও যখন ব্যর্থ হয়ে পড়ে তখন বিবাহ নামক সংযোগ সেতুকে ছিন্ন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ইসলামে। কোরাণে উল্লেখ আছে "তোমরা স্ত্রীকে যখন তালাক দিতে চাও তখন ইদ্দতের গণনা করো"। তালাক নির্দিষ্ট সময়ের ব্যাবধানে তিন বারে দিতে হয়। একবারেই তিনবার তালাক উচ্চারণ করলে সে তালাক বৈধ নয়। একমাসে একবার তালাক দেওয়া যায়। ঋতুকালীন অবস্থায় তালাক দেওয়া যায় না। একবার তালাক দেওয়ার পরও স্ত্রী স্বামীর ঘরে থাকবে। অর্থাৎ এখনো তাদের মধ্যে আপোষ মীমাংসার সুযোগ থাকে, তারা বিচার বিবেচনা করতেই পারে। প্রথম তালাকের পরও দুজনের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি না হলে প্রথম তালাকের একমাস পরে স্বামী দ্বিতীয় তালাক দিতে পারে। এরপরেও সমঝোতা অসম্ভব হলে আরো একমাস পর তৃতীয় তালাকের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ সম্ভব হয়। তিন তালাক মানে তিনটি সময়ে তালাক, একস্থানে শতবার তালাক বললেও সেটি বৈধ নয়। বরং সেটি একবার তালাক দেওয়া বলে গ্রাহ্য হবে। রাগ ও উত্তেজনার বশে অনৈতিকভাবে তালাক দিয়ে স্বামী তার স্ত্রীর পরবর্তী জীবনকে কঠোর সংঘর্ষময় করে তুলেছে অনেক ক্ষেত্রেই। আরব দেশগুলিতে কখনোই এভাবে তালাক হয় না।
স্ত্রীদেরও অধিকার আছে তালাক দেওয়ার, সেটিকে খোলা তালাক বলে। এক্ষেত্রে স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া সম্পদ সে স্বামীকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে।
এবার তিনতালাক আইনের ধোঁয়াসার কথা উল্লেখ করবো। সুপ্রীম কোর্ট পূর্বেই তাত্ক্ষণিক তিন তালাক অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। তারপরেও স্বামী তাতক্ষণিকভাবে তিন তালাক দিলে আইনের চোখে সে অপরাধী হলো, তাদের বিবাহবিচ্ছেদ কিন্তু হলো না, (কারণ ম্যাজিস্ট্রেট-এর তত্ত্বাবধানে বিচ্ছেদ হবার কথা) অপরাধের জন্য তিন বছর কারাদন্ড, জরিমানা ধার্য্যও হলো, কিন্তু যখন বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলোই না তাহলে স্ত্রী খোরপোষ দাবী করবে কেন? বা দাবী করলেও কার কাছে করবে? জেলে থাকা স্বামীর কাছে? আমরা তো জানি বিচ্ছেদ হলেই খরপোষের দাবী করা যায়। দ্বিতীয়ত, স্বামী জেলে থাকলে সেই স্ত্রী শ্বশুরবাড়ীতে কতটা নিরাপদ? তৃতীয়ত স্বামী জেলে থাকলে সে স্ত্রীকে খোরপোষ দেবে কোথা থেকে? চতুর্থত, শিশুকে মায়ের তত্ত্বাবধানে রাখার কথা আইনে বলা হলো, যেখানে বিচ্ছেদই হলো না সেখানে তত্ত্বাবধানের কথাটি এলো কি করে? পুলিসের কাছে স্ত্রী বা তার পরিবারের যে কেউ স্বামী তিন তালাক দিয়েছে বলে স্বামীর বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে পারে, এই অবস্থায় ব্যাপকভাবে বিনা দোষে ধরপাকড়ের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পরিশেষে বলা যায় তাত্ক্ষণিক তিন তালাক অমানবিক এবং কোরাণ ও হাদিস বিরোধী। এই প্রথা আইনমাফিকভাবে বন্ধ হওয়া যেমন প্রয়োজন ছিল তেমনই এক সিটিং-এ তিনবার তালাক উচ্চারণে তালাক যেহেতু গ্রাহ্য হয় না তাহলে স্বামীকে জামিনঅযোগ্য অপরাধে তিনবছরের জন্য কারাদন্ডটি গুরুদন্ড হয়ে গেলো নাতো? স্বামীর এহেন শাস্তিতে আর কোনদিনই তাদের মধ্যে সমঝোতা হবার আশা রইলো না। ভাবতে হবে, আর এই ভাবনার জন্যও আরেকটু সময় ও আলোচনার প্রয়োজন ছিল।
0 Comments.