Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অসিত কর্মকার (পর্ব - ৫)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অসিত কর্মকার (পর্ব - ৫)

যুদ্ধ যুদ্ধ

পাঁচ

আর পাঁচটা পাড়ার মতো মন্ডলপাড়াও এসময় ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে শান্ত। অনেক চেষ্টায় সয়েনির দেখা পেল লুকাস। তাকে এই অসময়ে দেখে সয়েনি হতভম্ব। লুকাস একগাল নিরুচ্চার হেসে বলল, আর চিন্তা নেই রে সয়েনি। আমাদের পাড়ায় এমন এক সাধু এসেছে যে তার মন্ত্রের জোরে কোনও বাধাই আমাদের দুজনের সম্পর্ককে ভাঙ্গতে পারবে না। সে এক আশ্চর্য সাধু। সয়েনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, সাধুমানুষের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক শুনি? তার উপর কিনা আমাদের দুজনের সম্পর্কের কথাও তাকে বলা হয়ে গেল এরমধ্যে! সে অনেক কথা। পরে তোকে সব বলব। এখন তোর ভাইটাকে ডেকে দে জলদি। সে সাধু আমাদের হাতেরটা খাবে না। পুলিন তার বাজারহাট করে দেবে। তারজন্য দয়ালদাদু সব ঘর থেকে পয়সা তুলেছে, খুব ভক্তিশ্রদ্ধাও করছে মানুষটাকে। গোঁসাই গোঁসাই বলে ডাকছে।আর সব বয়সী মানুষগুলো, এমনকী দশমী ঠাগমাও খুব মান্যি করছে তাকে। আমাদের পূর্বপুরুষদের আগের ধর্মের গুরুদেব কিনা! পুলিনকে চুপি চুপি ডেকে দিল সয়েনি।

কী কী জিনিস কিনতে হবে তা পুলিনকে বুঝিয়ে বলল দয়াল। তারপর তাড়া লাগাল, যা, যাবি আর আসবি। একটা ছোট মেয়ে কোত্থেকে একতাল গোবর এনে ফাঁকা জায়গাটার একধারে থপ করে ফেলে বলল, এমনি দিনে এখানে ওখানে কত গোবর পড়ে থাকে, আজ কিনা সেই নাবাল মাঠ পর্যন্ত রোদে পুড়ে যেতে হল! একেবারে হাঁপ ধরে গেল। ঢেলা তিনটের পাশে কিছু কাঠকুটো জড়ো করে রাখা হয়েছে। রোদের তাপ এখন খানিকটা ম্লান।জানোয়ারগুলোর সেই টানা বিকট চিৎকার না থাকলেও থেকে থেকে একটা দুটো ঘোৎ ঘোৎ শব্দ মানুষটার সারা শরীরে বিচুটিপাতার জ্বলন ধরিয়ে দিচ্ছে। যেন ওগুলোকে সামনে পেলে ঢিল মেরে একেকটার মাথা ফাটাত মানুষটা। মন তার দারুণ বিক্ষিপ্ত। তার উপর শরীর খিদের আগুনে পুড়ছে। নিমগাছটার গোড়ায় বসে দশমীবুড়ি। তার বয়সের গাছপাথর নেই। পরণের কাপড় ধুলোবালি মাখা। শুকনো কাঠের মতো শরীরে শিরা উপশিরাগুলো যেন অজস্র কেঁচোর কিলবিল। খোলা বুকে স্তনদুটো মরা রক্তের পুলটিশের মতো ঝুলে আছে। মাথায় ধবধবে সাদা তুলোর মতো চুল। চোখে ভাল দেখতে পায় না। দুই মাড়িতে দাঁত নেই একটাও। গালদুটো তোবড়ানো। সে অনেক কষ্টে মানুষটার মুখটা দেখার চেষ্টা করে। সেইসঙ্গে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিগুলোকে ধরতে চায়। শত চেষ্টা করেও ধরেও ধরতে পারে না যেন। মনের মধ্যে শুধু যেন কিছু শুকনো পাতা গড়াগড়ি খেলে। এদেশে চলে আসার সময় এই গোঁসাই মানুষটা তখন ছোকরা ছেলে। দৌড়িয়ে ঝাঁপিয়ে বেড়ায়। এর ওর বাগানের ফলমূল চুরি করে বেড়ায়। ধরা পড়লেও গোঁসাইয়ের ছেলে বলে তার সাত খুন মাপ! মাপ অন্যায় মারামারি, ধরাধরি আর দুষ্টুমিতেও।
হ্যাঁ বাবা হর, দেশের মানুষজন সব ভাল আছে তো? এগারোআনি বাড়ির মাঠে এখনও চড়কের মেলা বসে? বাল্লাগাছ ঘোরে? কীর্তিনাশা নদী এখনও আগের মতো রাক্ষুসি আছে? একের পর এক প্রশ্ন করে যায় দশমীবুড়ি। মানুষটাকে উত্তর দেওয়ার ফুরসত দেয় না। যেন সে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করছে। সব প্রশ্ন করা শেষ হলে নিজেই তাদের উত্তরের ঝাঁপি খুলে বসবে। ঐসব এখন আর নাই বুড়ি। হিন্দুই নাই তেমন তো মেলা, গলইয়া মেলাইব কারা? এক এক কইরা সব ভিডি ফাঁকা হইতাছে। কীর্তিনাশায় এখন হাঁডুজল মাত্তর। জোয়ার আর লাগে না তেমন। ভাটায় নদীর বুক জাইগ্যা ওঠে। মানুষজন হাঁইট্টা পার হয়। আর কথা বলতে ভাল লাগছে না মানুষটার। এখানেই থামে সে। চুপ করে থাকে। দয়াল মানুষটার কাছে দাঁড়িয়ে শুকনো হাসি হেসে বলল, জানোয়ারগুলোকে কিছু আনাজতরকারি দিয়ে এলাম। যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণই ওগুলোর মুখ চলে। যাকে বলে রাক্ষুসে খিদে। খাবার না পেলেই খানা থেকে উঠে এসে এখানে ছোটাছুটি বাঁধিয়ে দেয়। এখন থিকা তাইলে ওগুলারে বাইন্ধাছাইন্ধা রাইখো। মানুষটা বলল।
ও বাবা হর, তোমার সংসারপাতি নেই? সঙ্গে করে আনোনি কেন? দশমীবুড়ি ফের কথা বলতে শুরু করতেই মাথায় রক্ত চড়ে মানুষটার। এ্ই বুড়ি তো বড় জ্বালাইতাছে! আমি মরতাছি আমার জ্বালায়! গজগজ করতে করতে মানুষটা ফের বলল, নাই নাই, সাতকুলে আমার আর কেউ নাই। তোমরা আছ জাইনা অনেক আশা নিয়া এই দেশে পাড়ি দিছিলাম।কিন্তু এখন থিকা তোমরাও আমার কেউ না। না না, গোঁসাই, ও কথা মোটে বলবেন না। আমাদের কাছে আসায় আপনি কি জলে পড়েছেন? আমরা জাত খোয়াতে পারি কিন্তু মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিইনি গোঁসাই। শুনে খানিক স্বস্তির শ্বাস ফেলে মানুষটা। ভাবে, যাক, এদেশে পাড়ি দেওয়াটা একেবারে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া হয়নি তাহলে। বাজারমুখি রাস্তাটার দিকে তাকায়, পুলিন ছেলেটা আর কত দেরি করবে। ফতুর ফতুর, একেবারে ফতুর হয়ে গেছে সে। কালু শেখ ভিটি বিক্রির বাকি টাকাটা আর দিলই না। তাগাদা করতে করতে হতাশ হয়ে পড়েছিল মানুষটা। সে ইন্ডিয়ায় চলে যাবে শুনে কালু শেখ বলেছিল, তুমি গোঁসাইমানুষ, তোমারে আমি ঠকাম না। তবে টাকা আমি তোমারে একবারে দিতে পারুম না,তিন কিস্তিতে দিম।রেজিসটির দিন পোথম কিস্তির টাকা পাইবা। বাকি দুই কিস্তির টাকা তিন মাসের মইধ্যে পাইয়া যাইবা। দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেতে পেতে প্রথম কিস্তির টাকা শেষ। তৃতীয় কিস্তির টাকা আর পায় না। নিরুপায় হয়ে মানুষটা গ্রামের মাতব্বরের দ্বারস্থ হয়েছিল। মাতব্বর তাকে উল্টে শাসায়, এখন আমার কাছে আইছ কেন, ভিডি বিক্কির দেওনের আগে আগে আমার কথা মনে পড়ে নাই? আমরা থাকতে ঐ দুই পয়সা দামের মাইনষের কাছে গেছ ভিডি বিক্কির করতে! তোমার ভিডির নেইয্য মূল্য দেওনের ক্ষমতা আছে নিকি ঐ মাইনষের? যাউগ, যা ভুল করনের কইরা ফালাইছ, রেজিসটি যখন হইয়াই গেছে তখন ভিডির দখল কালু শেখরে না দিলে বিপদে তুমিই পড়বা! প্রমাদ গোনে মানুষটা। ভিটির দখল না দিলে মারদাঙ্গা না লাগায় কালু শেখ! বাকি টাকা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েই এদেশে পাড়ি দেয় মানুষটা।
দয়াল একরকম ধমক দিয়ে দশমীবুড়িকে বলল, গোঁসাইয়ের পেটে এখন খিদের জ্বালা আর তুমি কিনা রাজ্যের ওইদেশের কথা নিয়ে পড়েছ, চুপ যাও! তিনজনেই এখন চুপ।নিমগাছটার পিছনের ফাঁকা জায়গাটায় বাচ্চাগুলো আবার হুটোপাটি জুড়ে দিয়েছে। ওদের মনে ছেলেধরার ভয় আর নেই। ওরা একসময় হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে নাচে। মুখে মুখে ছড়া কাটার চেষ্টা করে, গোঁসাই গোঁসাই গোঁসাই...! তারপরই হা হা, হো হো করে হেসে উঠে মজায় মেতে উঠছে। ব্যস, এটুকুই। পরেরটুকু এখনও ওদের মনে দানা বাঁধেনি।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register