Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

শনিবারের পুরাণকথায় বাদল বিহারী চক্রবর্তী

maro news
শনিবারের পুরাণকথায় বাদল বিহারী চক্রবর্তী

মহালয়ার মঙ্গলালোক

মা আসছেন তাই দিকে দিকে ওই বেজে উঠছে মায়ের আলোর বেণু। মেঘমুক্ত আকাশ আর শিশিরসিক্ত শেফালী-বকুল ছড়ানো শারদ প্রভাতের বিশ্বনিসর্গ আজ যেন এক অপরূপ সৌন্দর্য্যে স্নিগ্ধ কারুকাজের শিল্পরাগে প্রতিভাত হচ্ছে। মা আসবেন- অন্তহীন ফুলেল কার্পেটে রাখবেন তাঁর রাঙা পায়ের ছাপ। ভক্তগণ সেই জোড়া পাদপদ্মের উদ্দেশ্যে সাষ্টাঙ্গে নিজেকে সমর্পণ করে আত্মপ্রসাদ আর মায়ের নৈকট্য লাভ করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। অগাধ ভক্তিমাখা কল্পনায় তারা মাকে চিত্রায়িত করেন এক ভুবনমোহিনী মূর্তিধারিনী দেবী দুর্গা রূপে। পুরাকালে রম্ভাসুরের পুত্র- অত্যাচারী মহিষাসুর ব্রহ্মার আরাধনা করে মহাবর লাভ করে আরো অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলেন। মূঢ় অসুর স্বর্গের দেবীগণের শক্তিমত্তার বিশালতাকে তোয়াক্কাই করেন নি। শুধু বর প্রার্থনা,- 'কোনো দেবতা যাতে তাঁকে হত্যা করতে না পারেন' এমন প্রাপ্তির অহমিকায় তিনি সমগ্র স্বর্গ জুড়ে শুরু করেছিলেন তাঁর ষড়রিপুর তান্ডবলীলা। উপাখ্যানের এই মহিষাসুর নামের ব্যাখ্যা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। প্রকৃতপক্ষে মহিষ হলো একপ্রকার পশুর নাম, আর অসুর কথার অর্থ সুর-বিরোধী, যিনি দেব-দেবী কিছুই মানেন না। শক্তি আছে, যে শক্তি অসৎ পথে পরিচালিত। যুদ্ধক্ষেত্রে মহিষাসুর মায়াজাল বিস্তার করে বিভিন্ন রকমের ভয়ঙ্কর রূপ ধরে দেবী দুর্গার সাথে যুদ্ধ করেছেন, আক্রমণ করেছিলেন দেবীকে। এই মহিষ আর অসুরের সংযুক্ত নামই মহিষাসুর। অসুরের তান্ডবে দেবতাগণ নিরুপায় হয়ে শরণাপন্ন হলেন বৈকুন্ঠবিহারী নারায়ণের কাছে। অসুরের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে স্বর্গ-মর্ত্যের দেবতা ও প্রাণীদের। এমন ক্রান্তিকালে দেবতাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়- যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো দেবতা নয়, দেবীই পারেন এতাদৃশ মহিষাসুরকে বধ করতে। স্রষ্টার এক অমৃত বাণীর উপলব্ধি, অলক্ষ্য হতে যেন এসে গেলো অভয়ার এক বরাভয় বারতা- ' ভয় নেই স্বর্গ-মর্ত্যবাসী, উপায় আছে যে এবার, মহিষাসুরকে বধ করিবার। যেহেতু মহিষাসুর তার মায়াজাল সৃষ্টি করে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে দেবীকে দশ দিক থেকে আক্রমণ শুরু করলেন, দেবী দুর্গাও তাই দশভুজা-রূপে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে সজ্জিভূত হলেন দেবতাদের প্রদত্ত সশস্ত্রে। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর সহ অপরাপর দেবগণ দেবীর সুশোভিত দশটি হস্তে অস্ত্র, দশদিক থেকে অধিকতর বিক্রমে মহিষাসুরকে আক্রমণ করার জন্য। কোমরে আঁচল বেঁধে রণরঙ্গিনী বেশে দেবী শুরু করলেন তাঁর রণনৈপুণ্য। তাঁর বাণ, শূল, সর্প, খড়গাঘাতে একে একে অসংখ্য অসুরের লাশ পড়ে গেলো। তবু যেন নিঃশেষ হতে চায় না অসুরের দল। এমন সময় দেবীর উপর পুষ্পবৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে ঊর্ধে থাকা দেবগণ কর্তৃক আশীর্বাণী হিসেবে। তুমুল যুদ্ধশেষে এক পর্যায়ে ভুলুন্ঠিত হয়ে যায় পরাক্রমশালী মহিষাসুর দেহ, দেবীর শূলাঘাতে। অসুরের অত্যাচার থেকে মুক্ত হলেন দেবগণ। স্বর্গ ও মর্ত্যে দুষ্ট দমিত হয়ে শিষ্টের মুখরিত প্রাণচাঞ্চল্য শুরু হলো। ভক্তগণ দেবীর জয়গান আর তাঁর স্তব-স্তুতি দিকে দিকে ছড়িয়ে দিলেন অবনতমস্তকে, মহানন্দে। স্বামী জ্ঞানপ্রকাশানন্দ তাঁর 'মহিষাসুর বধ'- এর তত্বকথা প্রবন্ধে বোঝাতে চেয়েছেন- 'পুরাণে বর্ণিত উপর্যুক্ত উপাখ্যানটি গভীরভাবে অনুধাবন করলে দেখা যায়, দেব ও অসুরের মধ্যে সংগ্রাম চিরকালের। যেন সু এবং কু- এর মধ্যে লড়াই। মানবের অন্তরেও দৈবশক্তির সঙ্গে আসুরিক শক্তির লড়াই যুগ যুগ ধরে লেগেই আছে। মানব মন তিনটি গুণে গুণান্বিত; তমোগুণ, রজোগুণ এবং সত্ত্বগুণ। দেখা যায়, তমোগুণের অধিকারী মানবের মধ্যে পাশবিকতা অর্থাৎ পশুবৃত্তিগুলো বিদ্যমান- আহার, নিদ্রা, মৈথুন এদের সর্বস্ব। আবার রজোগুণের মানুষ দেখা যায়, তারা কর্মের প্রতি আসক্ত। কিন্তু সে কর্ম নিষ্কাম নয়, সকাম ধর্মের- যা মানবকে মুক্তির পরিবর্তে বন্ধনের কারণ হয়। আমরা এটি অসুরের মধ্যে দেখতে পাই। পুরাণ মতে- যাঁরা দৈবী সম্পদলাভ করেছে, তাঁদের ভয়শুন্যতা, ব্যবহারকালে প্রবঞ্চন ও মিথ্যা বর্জন, জ্ঞান ও যোগে নিষ্ঠা, সামর্থনুসারে দান, বাহ্যেন্দ্রীয়ের সংযম, যজ্ঞ, স্বাধ্যায়, তপস্যা, সরলতা, অহিংসা, সত্য, ক্রোধহীনতা, ত্যাগ, শান্তি, পরদোষপ্রকাশ না করা, দীনে দয়া, লোভরাহিত্য, মৃদুতা, অসৎ চিন্তা ও অসৎ কর্মে লজ্জা, অচপলতা, তেজ, ধৈর্য্য, বাহ্যাভ্যন্তর শৌচ, অবৈরীভাব, অনভিমান, ক্ষমা, পরোপকার, নিরহংকারিতা ও ঈশ্বর প্রণিধান এগুলোই দৈবশক্তি-যাকে বলা হয় সত্ত্বগুনজাত। মানবমনে আসুরিক ও পাশবিক ভাবের প্রাবল্যে সত্ত্বগুনগুলো প্রকাশিত হতে বাধা পায়। কিন্তু সাধনার মাধ্যমে আসুরিক, পাশবিক চিন্তাগুলো দূরীভূত করতে পারলে বৈভবগুলোর স্ফুরণ ঘটে। আর তখনই মানুষ প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী হয়ে ভগবানলাভের যোগ্য হয়। মানব জীবন সার্থক করে তোলে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্ত মনের কোটি কোটি ভক্তজন আশায় বুক বাঁধে- বিশ্ব, তথা দেশমাতৃকার বক্ষ হতে যত দুরাশয়, দুষ্ট চিন্তা ও আসুরিক মনোভাব লালিত যত দুর্গ্রহ যাতে নিঃশেষ হয়ে যায়। মাথা উঁচু করে গর্বভরে ধারণ করবে প্রতিটি দেশমাতা সেদিন, যেদিন তার সকল ধর্মের মিলন মেলার চাদরে মোড়ানো সন্তানদের কল্যানে বিশ্বমাতা মহামায়া দেশমাতার বক্ষে রাখবেন তাঁর যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর দ্যুতি বিচ্ছুরিত রাঙা পা। ঢাক, ঢোল আর শঙ্খরবে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ধ্বনিত হবে- দুর্গা-মাই-কি-জয়! নাচে মন সন্তানের, নাচে ভক্তের- তাই তো কান পেতে শুনি আজ মায়ের পদধ্বনি-
আনছেন মা মঙ্গলালোক জ্বেলে দোলায় দোলে সুশোভায়, পুত্র-কন্যা সমভিব্যাহারে- তাই অসুর আর জঙ্গীপনার আজই হইবে বিদায়।
বিশ্ব হোক আনন্দময় মহালয়ার মঙ্গলালোক দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register